লাখ টাকার বরাদ্দে বেঁচে থাকে প্রকল্প

>

* প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না
* এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বছরের পর বছর প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখা হয়
* এবারের এডিপিতে এমন প্রকল্প ৫৫টি

সরকারের পক্ষ থেকে বানিয়ে দেওয়া ভবনে বাস করবেন দেশের অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা। এ জন্য প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালে। প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনো খরচ হয়নি। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ মাত্র এক লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে এক টাকাও খরচ হয়নি। এক লাখ টাকা দিয়ে প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

প্রতিবছর যদি এভাবে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখা হয়, তবে প্রকল্পটি শেষ হতে ২ লাখ ২৭ হাজার ৩২১ বছর সময় লাগবে। অথচ প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা।

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য পছন্দের পর্যটন এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কেরানিরহাট থেকে বান্দরবান শহর পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটির মান উন্নয়নে গত জুলাই মাসে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ মাত্র এক লাখ টাকা। বাকি দুই বছরে প্রকল্পের বাকি ২৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এখানেও প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে।

এভাবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৫৫টি প্রকল্প মাত্র এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে আছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ, সেতু তৈরি, সড়ক উন্নয়ন, রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক সময় কিছু প্রকল্প নেওয়া হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এ জন্য প্রকল্পগুলোকে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এ ছাড়া ভূমির বিষয়টি ফয়সালা না করেই অনেক প্রকল্প পাস করা হয়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণের সময় নানা মামলা–মোকদ্দমায় প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা যায় না। আবার বিদেশি সহায়তা পাওয়া গেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, এমন প্রত্যাশা থেকেও কিছু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে বিদেশি সহায়তা পাওয়া যায় না, প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয় না। যেহেতু প্রকল্পটি এডিপির বইয়ে ঢুকে যায়, তাই বছর বছর এক-দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেমন ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি ২০১১ সালে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের প্রথম দুটি এলওসিতে অনুমোদন না পাওয়ায় প্রতিবছরই প্রকল্পটিতে এক-দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই এডিপিতে নতুন নতুন প্রকল্প পাস করা হয়। ঢুকে পড়া এসব প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হয়। কিন্তু পুরোনো প্রকল্পগুলোতেও বরাদ্দ দিতে হয়। গত ১০ বছরে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সব প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে গিয়ে ছোট প্রকল্পগুলো সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। এর ফলে লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস দেখা যায় প্রতিবছর। এতে ওই সব কম অগ্রাধিকারের প্রকল্প বছরের পর বছর এডিপিতে থেকে যায়। এডিপিতে বাড়ে প্রকল্পের সংখ্যা। ফলে এডিপির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।

এবার আসা যাক এডিপিতে শূন্য বাস্তবায়নের প্রকল্পের সংখ্যা কেমন। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০টি প্রকল্পে কোনো টাকা খরচ হয়নি। এগুলো ‘শূন্য’ অগ্রগতির প্রকল্প হিসেবে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে না পারায় প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই ৯০টি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯টি প্রকল্প হলো জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের। মূলত জমি নিয়ে জটিলতার কারণেই এই আবাসন প্রকল্পগুলো শুরু করা যাচ্ছে না বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আবার ২০১৬ সালের ২৬৪ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা শহরে তিনটি পাইকারি মুরগির বাজার তৈরির একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রকল্পটিতে গত তিন বছরে কোনো টাকা খরচ হয়নি। তা সত্ত্বেও প্রতিবছর নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত যথাসময়ে জমি না পাওয়ার কারণে প্রকল্পগুলোকে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। আমি মনে করি, খুব জরুরি না হলে এই ধরনের প্রকল্প বাঁচিয়ে না রাখাই ভালো। নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বছরের পর বছর প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখলে এডিপির আর্থিক শৃঙ্খলা কিছুটা বিঘ্নিত হয়। প্রকল্প পাসের আগেই বাস্তবায়ন পরিকল্পনা থাকলে ভালো।’