টানা দরপতন কিছুতেই থামছে না

>

• গতকালও মতিঝিলে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা
• বিক্ষোভ চলছে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে
• বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় তলানিতে
• বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিও।

শেয়ারবাজারের টানা দরপতন কিছুতেই থামছে না। পতন ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার সূচক টেনে তোলা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সপ্তাহে তা আর স্থায়ী হয়নি। ফলে চলতি সপ্তাহের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বড় ধরনের দরপতন দেখল শেয়ারবাজার।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল এক দিনেই ৬১ পয়েন্ট বা প্রায় ১ শতাংশের মতো কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ২৪৯ পয়েন্টে। সেই সঙ্গে লেনদেন কমে নেমে এসেছে ২৭০ কোটি টাকায়। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি কমেছে ১৮৮ পয়েন্ট। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ কার্যদিবসে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি কমেছে ২৭৩ পয়েন্ট। এর ফলে গতকাল ডিএসইর সূচকটি গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে।

ঢাকার বাজারে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশেরই দাম কমেছে। দাম বেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের। মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকালের বাজারে সূচকের পতনের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ব্র্যাক ব্যাংকের।

 ডিএসইতে গতকাল স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের দাম দেড় শতাংশ বা ৪ টাকা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দাম ২ শতাংশ বা ৩১ টাকা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের দাম দেড় শতাংশের বা ১ টাকা বেশি কমেছে। যদিও এ দরপতনের সঙ্গে কোম্পানির ভালোমন্দের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাশাপাশি কমেছে বড় মূলধনি কোম্পানি গ্রামীণফোনের দামও। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম গতকাল পৌনে ২ শতাংশ বা সাড়ে ৬ টাকা কমেছে। টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার পাওনা দাবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১০ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৪৫ টাকা কমে ৩৭২ টাকায় নেমে এসেছে।

 এদিকে, দরপতনের প্রতিবাদে গতকালও রাজধানীর মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময় তাঁরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন, বাজে কোম্পানির লেনদেন ও প্লেসমেন্টে শেয়ারের অবৈধ লেনদেন বন্ধসহ আরও বেশ কিছু দাবি জানান। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে বিনিয়োগকারীদের এ বিক্ষোভ চলছে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে।

বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা দরপতনের কারণে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় তলানিতে নেমে গেছে। আস্থা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিও। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কেউই বাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। আবার অনেক শেয়ারের অস্বাভাবিক দরপতনের ফলে জোরপূর্বক বিক্রির (ফোর্সড সেল) ঘটনাও ঘটছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের অনেকেই মনে করেন, শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে সবার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি কারসাজি রোধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, বাছবিচার ছাড়া লেনদেন হওয়া অধিকাংশ শেয়ারেরই দাম কমছে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যখন চরম আতঙ্ক ভর করে, তখনই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

 জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে অনেক কোম্পানির শেয়ারের দামই বর্তমানে অবমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। এমন বাজারে টানা পতন ও বাছবিচার ছাড়া সব কোম্পানির দাম কমে যাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণই নেই। তাই বাজারের এ পতনের পেছনে কোনো ধরনের কারসাজি রয়েছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখার পরামর্শ তাঁর। এসইসির এই সাবেক চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করা ছাড়া এ বাজারকে আবারও ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরানো যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হলে ধীরে ধীরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন।

 এদিকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল–সুবিধা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বেশ কিছুদিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিল। এই তহবিল সহায়তা নিয়ে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হক।

বৈঠকের বিষয়ে কাজী সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনই আলোচনা হচ্ছে। আমরা সরকারের কাছ থেকে স্বল্প সুদে যে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল–সুবিধা চেয়েছি, তা সরকারের দিক থেকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। সুবিধাটি পেলে বাজারে আমাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও অনেক বাড়বে।

বাজারের পতন ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু নীতি সহায়তা দরকার বলেও মনে করেন ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো এখন তারল্যসংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারের অংশগ্রহণে কিছুটা শিথিলতা দরকার।

এনবিআরের ব্যাখ্যা
শেয়ারবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব খুলতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে। এনবিআর বলেছে, বিনিয়োগকারীরা আগে যে প্রক্রিয়ায় বিও হিসাব খুলতেন, এখনো সেই প্রক্রিয়ায় তা খুলতে পারবেন।