বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বৈষম্য কমানোর তাগিদ

আইসিএবি ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে ‘কেমন চাই জাতীয় বাজেট: ২০১৯-২০’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গতকাল কারওয়ান বাজার সিএ ভবনে।  ছবি: প্রথম আলো
আইসিএবি ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে ‘কেমন চাই জাতীয় বাজেট: ২০১৯-২০’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গতকাল কারওয়ান বাজার সিএ ভবনে। ছবি: প্রথম আলো

আগামী ২০১৯–২০ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকতে হবে। তাই বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কর–সুবিধা দিতে হবে। এ ছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত। সার্বিকভাবে বাজেটের উদ্যোগগুলো এমন হতে হবে, যেন তা বৈষম্য কমায়। এ ছাড়া অর্থনীতিতে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার খাত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও কর ছাড় দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও প্রথম আলো আয়োজিত গতকাল বৃহস্পতিবারের গোলটেবিল সভায় বক্তারা এসব সুপারিশ করেন। গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল ‘কেমন চাই জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সভাপতিত্ব করেন আইসিএবির সভাপতি এ এফ নেছারউদ্দিন।

এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, এ বছর করপোরেট কর কমানোর দাবি উঠেছে। করপোরেট কর কমানো জটিল কাজ। করপোরেট কর কমানোর ফলে যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, তা অন্য উৎস থেকে আদায় নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবি, নতুন আইনে পণ্যভিত্তিক সংকুচিত ভ্যাট হার যেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা হয়। সব বিষয়ে ব্যবসায়ীদের ঐকমত্য করতে হলে রাজস্বই আদায় করতে পারব না। সবাই ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে চাইবে।

প্রত্যক্ষ কর আদায় বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সময় আমি চেয়েছি যাঁরা নির্বাচন করবেন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থীদেরও আয়কর বিবরণীর অনুলিপি জমা দিতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা করতে পারিনি। এটা করতে চেষ্টা করতে হবে। যাঁরা জনপ্রতিনিধি তাঁদের অনেকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই।’

দুর্নীতি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘দুর্নীতি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে। উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের আয় বাড়বে, তখন দুর্নীতিও কমে আসবে। আমি নিজেও এই বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের হেদায়েত করি। এতে কাজ হচ্ছে।’

দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে বলে মনে করেন সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। এই বৈষম্য কমাতে না পারলে সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাই তিনি বাজেটে এই বিষয়ে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীর মতে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের চাহিদা বাড়তে থাকলে একসময় ব্যাংকগুলো সেই চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। ফলে বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারে যাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এখন সহজেই ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া যায়, তাই দেড় বছর অপেক্ষা করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিতে চায় না কোনো কোম্পানি।

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুপারিশ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে যে ভালো ফল আসে, এর উদাহরণ হলো আমাদের ক্যাডেট কলেজ।’ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না করলে বৈষম্য কমবে না বলে তিনি মনে করেন।

আইসিএবির সভাপতি এ এফ নেছারউদ্দিন বলেন, করদাতার সংখ্যা ও আয়কর বৃদ্ধি করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামর্থ্যবানদের করের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, কর প্রশাসন নিয়ে এ দেশের জনগণের মধ্যে ভীতি আছে। এই ভীতি দূর করার জন্য কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন দরকার।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ৮ শতাংশের বেশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল উৎস হলো ভোগ। উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে এটা কাম্য নয়। এমন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়বে, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগে চাঞ্চল্য নেই। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ শতাংশ। ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে তরুণদের কর্মসংস্থান কঠিন বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন ফাহমিদা খাতুন।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সহসভাপতি কামরুল ইসলাম বলেন, ভারতে প্রবাসীরা দেশে ফিরে এলে তাঁদের পাঁচ বছরের জন্য করমুক্ত–সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এতে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় প্রবাসী সে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশেও সে ধরনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহার কমানোর প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানি করহারের ব্যবধান বাড়লে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে। তিনি আরও বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় বিএসইসি। কিন্তু যখন করহার নির্ধারণ করা হয়, তখন ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার কমানোর সুপারিশ করেন তিনি। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকে লভ্যাংশের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। এতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

আইসিএবির সদস্য ও ডেভো টেকের চেয়ারম্যান রায়হান শামসী বলেন, এনবিআরকে শুধু রাজস্ব আদায়ের দিকে জোর দিলেই হবে না; ব্যবসা-বাণিজ্যসহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবসায় তরুণেরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের জন্য ৫ থেকে ৭ বছর করমুক্ত–সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সহসভাপতি মুশফিকুর রহমান বলেন, ডিজিটাল ব্যবস্থায় বাজারজাতকরণের লেনদেন আরও সহজ করা উচিত। এতে ৩০০-৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া যাবে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত।

বাজার চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ তৈরির দিকে মনোযোগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য কামরুল আবেদিন। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুলসংখ্যক চাকরির সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের উচিত বাজার চাহিদা অনুযায়ী তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় বিনিয়োগ করা।

সংস্থাটির আরেক কাউন্সিল সদস্য স্নেহাশিস বড়ুয়ার মতে, বার্ষিক আয় নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে অনলাইন ব্যবস্থায় কর বিবরণী জমা ও কর পরিশোধের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ভারতও এমন ব্যবস্থা চালু করে সফল হয়েছে। এ ছাড়া করপোরেট করহার নিয়ে পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। এতে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা করতে পারবেন।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য হ‌ুমায়ূন কবির।

অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু উপস্থিত না থাকায় তাঁর পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য হ‌ুমায়ূন কবির। বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি নতুন আইনে সংকুচিত ভ্যাট হারে পণ্য অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবসায়ীদের মতামত নেওয়ার ওপর জোর দেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইসিএবির সহসভাপতি মো. সেলিম উদ্দিন, কাউন্সিল সদস্য শাহাদাৎ হোসেন, সচিব মুহাম্মদ ইমরুল কায়েস প্রমুখ।