নতুন ভ্যাট আইনের জট খোলেনি

>
  • কোন পণ্যে কত ভ্যাট হবে তা এখনো ঠিক হয়নি।
  • প্রভাব সমীক্ষার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।
  • ইসিআর যন্ত্র কেনার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি।

তেমন প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন আইনে একটি হারের পরিবর্তে একাধিক হার হবে। আইন বাস্তবায়নে আর মাত্র দুই মাস সময় আছে। কিন্তু এখনো কোন পণ্যে কত ভ্যাট হবে, তা ঠিক করা হয়নি। যেসব ব্যবসায়ী কম হারে ভ্যাট দেবেন, তাঁরা রেয়াত নিতে পারবেন কি না, তা–ও স্পষ্ট করা হয়নি।

নতুন আইনে রিটার্ন জমা, কর পরিশোধসহ সব কাজই অনলাইনে হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করবে, তা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো নির্দেশনা দেয়নি। হিসাব রাখার জন্য কেনা দামে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো কোনো ব্যবসায়ী তা হাতে পাননি। এমনকি ইসিআর কেনার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি।

এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইন অর্থনীতি ও পণ্যের দামে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে একটি মূল্যায়ন করার কথা থাকলেও সেটার কাজই শুরু করতে পারেনি এনবিআর। মূল্যায়ন ছাড়াই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।

এ অবস্থায় বাজেট ঘোষণার ৩৯ দিন আগে অর্থাৎ ৫ মে এনবিআরকে চিঠি দিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) অভিযোগ করেছে, নতুন ভ্যাট আইনে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে গত দুই বছরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। অপ্রস্তুত ও মূল্যায়ন ছাড়া আইনটি বাস্তবায়িত হলে পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে।

নতুন ভ্যাট আইনটি তৈরি হয় ২০১২ সালে। নানা কারণে তখন তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে এটি কার্যকর করার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে শেষ মুহূর্তে আইনটির বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।

নতুন ভ্যাট আইন সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, একাধিক হারে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করার চিন্তাভাবনা চলছে। এতে আইনটির বিচ্যুতির হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে। দুবার ভ্যাট দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেমন, বলা হচ্ছে যাঁরা ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবেন, তাঁরা মূসক রেয়াত সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আগের পর্যায়ে যে ভ্যাট দিয়ে এসেছে, তা যোগ করলে তো ১৫–২০ শতাংশ ভ্যাট হয়ে যাবে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আগে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাতে হবে, নতুন আইনে কোন পণ্যে কত ভ্যাট হার হবে। তারপর প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সফটওয়্যার সেভাবে সাজাবে। কিন্তু এসব বিষয়ে এনবিআরের তেমন প্রস্তুতি নেই। তাই হঠাৎ করে বাজেটে নতুন আইনটি বাস্তবায়নের কথা বললে ব্যবসায়ী কিংবা এনবিআরের কোনো পক্ষেরই যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকবে না। এতে জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

বর্তমানে ট্যারিফ লাইনে ৬ হাজার ৪৭৩ ধরনের পণ্য আছে। নতুন আইনে মৌলিক খাদ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় ১ হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবা আছে। বাকি ৪ হাজার ৮১৬টি পণ্য ও সেবার আমদানি বা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট আরোপিত হবে।

প্রস্তুতি নেই
ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার পর ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, একাধিক ভ্যাট হার নির্ধারণের পাশাপাশি যেন একটি প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করা হয়। গত ৩১ মার্চ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঐকমত্য হয়, নতুন আইনে ৫, সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এ ছাড়া কিছু পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও থাকবে। কিন্তু কোন কোন পণ্যে কম হারের ভ্যাট হবে, তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।

গত বছরের ২৯ নভেম্বর নতুন ভ্যাট আইনের প্রভাব মূল্যায়ন করার দাবি জানিয়ে চিঠি দেয় এফবিসিসিআই। এরপর দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের সমীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে এনবিআর। প্রতিষ্ঠানগুলো সমীক্ষা করতে আগ্রহী হয়নি বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এরপর সমীক্ষা করার উদ্যোগটি আপাতত বন্ধ রয়েছে। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি এনবিআরের সঙ্গে এক বৈঠকে এফবিসিসিআই ভ্যাট আইনের সুবিধা-অসুবিধা যাচাইয়ে একটি সমীক্ষা করার অনুরোধ জানায়। তবে এনবিআর নতুন আইন বাস্তবায়ন শুরুর পর এর প্রভাব দেখে সমীক্ষা করতে পারে বলে জানা গেছে।

দুই বছর আগে যখন আইনটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তখন কী ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করা হয়নি। এরপরের অগ্রগতি হলো গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১১টি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে পেরেছে এনবিআর। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ওই সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সফটওয়্যার নেয়নি।
উল্লেখ্য, বার্ষিক পাঁচ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চাইলে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারবে।

মাঠপর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিজেদের বেচাকেনার হিসাব রাখার জন্য দুই বছর আগেই কেনা দামে ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল এনবিআর। সেই উদ্যোগেও অগ্রগতি নেই।

অবশ্য প্রস্তুতি নেই তা মানতে নারাজ এনবিআর। এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) আবদুল মান্নান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে এনবিআরের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। নতুন আইনটি নিয়ে সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, সেভাবেই বাস্তবায়ন করা হবে।’ তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।

চিঠিতে ক্ষোভ ও আশঙ্কা
ভ্যাট আইন নিয়ে এনবিআরকে লেখা এফবিসিসিআইর চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জুন মাসে ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। কিন্তু এ সময়ে এ আইন সংশোধনে এনবিআরের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

ভ্যাট আইন নিয়ে ২ মে একটি সভা ডেকেছিল এনবিআর। কিন্তু পরে তা বাতিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে চিঠিতে এফবিসিসিআই বলেছে, ‘সভা আয়োজন করে তা না করা খুবই হতাশাব্যঞ্জক।’ একই সঙ্গে গত দুই বছরে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত না হওয়া অংশীজনদের পরামর্শ উপেক্ষা করারই শামিল। এ কারণে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’

ভ্যাট আইন নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের উদ্বেগের মূল বিষয় হলো কোন পণ্যে ভ্যাটের হার কত হচ্ছে, কম হারগুলোর ক্ষেত্রে রেয়াত নেওয়ার সুযোগ থাকছে কি না, সম্পূরক শুল্ক কোথায় বসানো হচ্ছে, কোথায় তুলে নেওয়া হচ্ছে, এতে দেশীয় শিল্পের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে। এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব হলো, ১৯৯১ সালের আইনে যেসব পণ্য ও সেবায় সম্পূরক শুল্ক আছে, সেটা ২০১২ সালের আইনে হুবহু রাখা।

চিঠিতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করে এফবিসিসিআই বলেছে, অপ্রস্তুত ও পুনর্মূল্যায়নে সময়ক্ষেপণ করা ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে, যা গণমানুষের বিপক্ষে যাবে। এতে সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। কেননা, ১৫ শতাংশের কম হারের ক্ষেত্রে রেয়াত নেওয়ার সুবিধা না থাকলে তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

সার্বিক বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সদ্য বিদায়ী সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন পণ্যে কত শতাংশ ভ্যাট, কোন কোন ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাচ্ছে, এসব বিষয়ে আমরা এখনো কিছু জানি না। একাধিক হার হলে রেয়াত নেওয়ার সুবিধা থাকবে কি না, তা–ও অস্পষ্ট। এনবিআর বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করছে, তবে একটা উপসংহারে কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গেই আসতে হবে।’

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশে নতুন ভ্যাট আইন করার জন্য সুপারিশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তৎকালীন সরকার আইএমএফের ওই সুপারিশ আমলে নেয়নি। যুক্তি ছিল, অভিন্ন ভ্যাট হার করার সময় আসেনি। এরপর ২০০৯ সালে নতুন সরকার আসার পর আইএমএফ নতুন ভ্যাট আইন করার বিষয়ে আবারও তাগিদ দেয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশকে বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) প্রায় ১০০ কোটি ডলার অনুমোদন করে আইএমএফ। এই ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট আইন করা। সেই আইনটি এবার বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।