সুবিধা নিয়ে মুনাফায় ১২ ব্যাংক

বেসরকারি খাতের ওয়ান ব্যাংককে ২০১৮ সালের আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করার সময় ৯৯৮ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) সংরক্ষণ করতে বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকটি রাখতে পেরেছে ৭৫৮ কোটি টাকা। বাকি ২৪০ কোটি টাকা ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে ধাপে ধাপে সংরক্ষণের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি গত বছর ১৪০ কোটি টাকা মুনাফা দেখাতে পেরেছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে শেয়ারধারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি ব্যাংকটি। তাই বছর শেষে ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের জন্য ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

একইভাবে ন্যাশনাল ব্যাংককে ২০১৮ সালের জন্য ২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকটি রাখতে পেরেছে ১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটি ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বিশেষ সুবিধার পাওয়ায় ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ৪১০ কোটি টাকা মুনাফা দেখাতে পেরেছে। যেহেতু সঞ্চিতির ঘাটতি রয়েছে, তাই ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে শেয়ারধারীদের জন্য নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি।

শুধু ওয়ান ও ন্যাশনাল ব্যাংক নয়, নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে একই ধরনের সুযোগ নিয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কমপক্ষে আরও ১০টি ব্যাংক। এর ফলে ২০১৮ সালে লোকসানের পরিবর্তে ব্যাংকগুলো মুনাফা দেখাতে পেরেছে আর্থিক হিসাবে। যেহেতু এসব ব্যাংকের সঞ্চিতির ঘাটতি রয়ে গেছে, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ২০১৮ সালে নগদের পরিবর্তে শেয়ারধারীদের জন্য বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে ব্যাংকগুলো। এর বাইরে আর্থিকভাবে খারাপ অবস্থার কারণে বেসরকারি খাতের এবি, বাংলাদেশ কমার্স, পদ্মাসহ কয়েকটি ব্যাংককে কোনো ধরনের মুনাফা বিতরণের অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

কারা পেল বিশেষ সুবিধা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সব ব্যাংকই নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। তাই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক শেয়ারধারীদের জন্য নগদের পরিবর্তে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ওয়ান, ন্যাশনাল, প্রিমিয়ার, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক একই সুবিধা নেওয়ার কারণে নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি, সোশ্যাল ইসলামী ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকও একই সুবিধা নিয়েছে। তাই এরাও নগদের পরিবর্তে বোনাস দিয়ে শেয়ারধারীদের তুষ্ট করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বলেছে, ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিম, অন্যান্য সম্পদ, বিনিয়োগ হিসাব, আন্তশাখা লেনদেন হিসাব, আদালতের আদেশে নিয়মিত দেখানো ঋণ ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক খেলাপি করে দেওয়া ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে ২০১৮ সালের আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে। নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে যে ঘাটতি রয়েছে, তা ২০১৯, ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে পূরণ করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ এ সুবিধা নিয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেউ মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়েছে, আবার কেউ লোকসান কমিয়ে দেখিয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা সম্পর্কে অনেকটাই বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছে শেয়ারধারীরা।

>নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ২০১৮ সালে শেয়ারধারীদের জন্য নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি এসব ব্যাংক।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পরও আর্থিক অবস্থা ভালো থাকায় বিশেষ সুবিধা নিতে হয়নি বেশ কয়েকটি ব্যাংককে। এর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক, ডাচ্‌-বাংলা, ইস্টার্ণ, দি সিটি, ইউসিবি, আল-আরাফাহ্‌, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, এক্সিম, ইসলামী, যমুনা, এনসিসি, প্রাইম, পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক।

এমডিরা যা বলছেন

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ব্যাংকের নিজস্ব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে অনেক বেশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার প্রয়োজন হয়েছে। যেটা এক বছরে রাখা সম্ভব নয়। রাখতে হলে ব্যাংকগুলো নিট মুনাফা করতে পারত না। দেশের শেয়ারবাজারের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরের বছরে বাকি সঞ্চিতি রাখার সুযোগ দিয়েছে।

সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপ আদালত থেকে ঋণখেলাপি না দেখাতে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী এ ঋণের বিপরীতে বড় অঙ্কের সঞ্চিতি রাখতে হয়েছে।’ এ বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মেনেই সব করা হয়েছে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা যায়নি। পরের তিন বছরে তা সংরক্ষণ করা হবে।’