বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না, বাড়ছে বেকার

অনেক সূচকের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন ভালো সময়। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়াচ্ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। রপ্তানি আয় ভালো। বড় হচ্ছে স্থানীয় বাজার। এ রকম এক সুসময়েও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে এখন যে কয়টা বড় চিন্তার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ অন্যতম। সাধারণত সরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। তবে বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটা। সরকারি বিনিয়োগ দ্রুত হারে বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ সেই হারে বাড়ছে না।

বেসরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে আবার কর্মসংস্থানের যোগ রয়েছে। কারখানা বাড়লে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কাজ পেলে আয় বাড়ে, সেই সঙ্গে বাড়ে জীবনযাত্রার মান। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রবৃদ্ধির সুফল সবার ঘরে পৌঁছাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের হার একটা ফাঁদে আটকে গেছে। বিনিয়োগ যদি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ে, তাহলে কর্মসংস্থান হয় না। প্রকৃত মজুরি বাড়ে না। এতে স্থানীয় বাজার বড় হয় না। আবার স্থানীয় বাজারনির্ভর শিল্পেরও বিকাশ ঘটে না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ জিডিপির ২৭-২৮ শতাংশে উন্নীত করতে হলে এবং সেটা বছর বছর ধরে রাখতে হলে অনেককে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া, কিছু ধনী ও প্রভাবশালীদের মধ্যে সবকিছু ধরে রাখা—এ ধরনের একটা প্রবণতা তো দেখা যায়।

জাহিদ হোসেন মনে করেন, সরকারি নিয়মনীতির প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। বিনিয়োগে বাধা এত বেশি যে সবার পক্ষে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। তাই ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়নটি জরুরি। যেখানে নতুনেরা বিনিয়োগ করতে পারবেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও সক্ষমতা বাড়বে।

দেশে বিনিয়োগ একেবারেই বাড়ছে না, তা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে যে গতি দরকার, সেটা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ৮ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি, এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ৫ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ।

কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে দেখা হয় জিডিপির অনুপাতে। দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। মোটামুটি একই জায়গায় প্রায় স্থির হয়ে আছে।

কম কেন?
বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে না হওয়ার কারণ জানতে তিনজন অর্থনীতিবিদ ও চারজন ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর আলোচনা হয়। তাঁরা এ ক্ষেত্রে মোটা দাগে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। মূল কারণ বিনিয়োগ পরিবেশের তেমন কোনো উন্নতি না হওয়া। দেশে সরকারি নিয়মনীতি সমভাবে প্রয়োগ হয় না। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের পরিবেশে অভ্যস্ত। ঘুষ বা বাড়তি অর্থ ব্যয় করে লাইসেন্স, অনুকূল নীতি, সেবা সংযোগ তারা আদায় করে নিতে পারে। ব্যাংকও তাদের ঋণ দেয়। কিন্তু নতুন ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা সেটা পারে না।

দেশে এর ফলে বিনিয়োগ কিছু শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। বিনিয়োগ বড়দের মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রমাণ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। যেমন ২০১১-১২ অর্থবছরে মেয়াদি ঋণের ৬২ শতাংশ ছিল বড় শিল্পে। সর্বশেষ অর্থবছরে সেটা ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিপরীতে এ ক্ষেত্রে মাঝারি শিল্পের হিস্যা ৩১ থেকে কমে ১৪ শতাংশে নেমেছে। বিবিএসের উৎপাদনমুখী শিল্প জরিপ বলছে, গত ছয় বছরে মাঝারি কারখানার সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে, ক্ষুদ্র শিল্প বেড়েছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো ঘাটতি, বিকল্প অর্থায়নের অভাব, নিয়মনীতির অনিশ্চয়তা ইত্যাদি পুরোনো সমস্যাও রয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও অবকাঠামো ঘাটতিকে তিনটি শীর্ষ সমস্যা হিসেবে দায়ী করা হয়েছে।

অবশ্য ব্যবসা সহজ করতে সরকার সংস্কার করছে, যার সুফল পেতে এখনো দেরি। জমির সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত প্রভাব পেতে সময় লাগবে। বিদ্যুৎ পেতে এখনো অনেক সময় লাগে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কারণে গ্যাস সমস্যা কাটল সবেমাত্র।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এখন একধরনের নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে গেছে। যেখানে বড় উদ্যোক্তারা পুরো নেটওয়ার্ক নিজেদের মতো করে নেন। মাঝারিদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না।

দেশের রপ্তানি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় পোশাক খাত। গত পাঁচ বছরে এ খাতেও বড় গ্রুপগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। মাঝারি ও ছোটরা তেমন একটা পারেনি।

ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কে এম রেজাউল হাসনাত এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানাগুলোকে অগ্নি ও কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিনিয়োগ করতে পারলেও ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের পক্ষে সেটি করা সম্ভব হয়নি। সে জন্য বড়রা সক্ষমতা বাড়ালেও বাকিরা পারেনি। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামোগত দিক দিয়ে এখনো কিন্তু অস্বস্তি রয়েছে। সেটা সবে কাটতে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে অবকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়।

বেকার বাড়ছে
বিবিএস গত বছর শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করে। এতে দেখা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ বেশি। সার্বিকভাবেও বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেড় যুগ আগে ২০০০ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এ হার ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে। এই বেকার বলতে আবার এক সপ্তাহে অর্থের বিনিময়ে কোনো ধরনের কাজ না পাওয়া লোককে বোঝানো হয়েছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, তরুণদের বেকারত্বের হার সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ সালে এ হার ১২ দশমিক ৮-এ দাঁড়িয়েছে। বড় অংশের তরুণ আবার নিষ্ক্রিয়, যাঁরা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আবার কর্মসংস্থানও খুঁজছেন না। দেশে এমন তরুণের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

শ্রমবাজার জরিপ অনুযায়ী, ২০১৩ ও ২০১৫-১৬—দুই বছরে মোট কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১৪ লাখ, অর্থাৎ বছরে ৭ লাখ করে। কিন্তু ২০১০-১৩—এই তিন বছরে মোট কর্মসংস্থান বেড়েছিল ৪০ লাখ, অর্থাৎ বছরে ১৩ লাখ। অবশ্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমবাজার জরিপ বলছে, ওই বছর ১৪ লাখ মানুষ স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে। বিপরীতে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

এদিকে আবার বিদেশে কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে। ২০১৭ সালে ১০ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ পেয়েছিলেন, ২০১৮ সালে তা কমে ৭ লাখ ৩৪ হাজারে দাঁড়ায়।
ভিয়েলাটেক্সের চেয়ারম্যান রেজাউল হাসনাত মনে করেন, বেকারত্বের একটা বড় কারণ শিল্পের চাহিদার সঙ্গে পড়াশোনা ও দক্ষতার মিল না থাকা। তিনি বলেন, ‘পোশাকশিল্পে প্রচুর লোকের দরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংশ্লিষ্ট পড়াশোনা নেই। আপনি বয়লার চালানোর জন্য একজন কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক পাবেন না।’