নতুন কিছু নেই প্রথম ইনিংসে

অধিনায়ক বদল। মাঠটাও খুব মসৃণ নেই, আকাশের কোণে কোণে মেঘ। প্রতিপক্ষও আগের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু তিনি খেললেন সেই সনাতন পদ্ধতিতেই। উদ্ভাবনী তেমন কিছু ছিল না, কার পর কে আসবে, সেখানেও নতুনত্ব নেই।

ক্রিকেটপ্রেমী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈরী আবহাওয়ায় (পড়ুন চাপে থাকা অর্থনীতিতে) যে ইনিংসটি খেললেন, তাতে কেবল টিকে থাকাই হবে, জয় নিয়ে পরের ধাপে যাওয়া খুব সহজ হবে না। অথচ সময় এখন পরের ধাপে যাওয়ার।

নতুন অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটে গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতা আছে, এমনকি আছে গতানুগতিকতা। অথচ অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। প্রবৃদ্ধি যেমন সর্বোচ্চ, আয়বৈষম্যেও তেমন দেখা দিয়েছে নতুন রেকর্ড। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি এর বড় কারণ। আর্থিক খাত চরম সংকটে, নগদ টাকার সংকটে বেশির ভাগ ব্যাংক। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুদ পরিশোধ ব্যয় লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে। রাজস্ব আদায়ে চরম ঘাটতি। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নতুন করে যে চাপ দেখা দিয়েছে, তার স্বীকৃতি যেমন বাজেটে নেই, তেমনি নেই প্রতিকারের জোরালো কোনো পরিকল্পনা।

টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রথম পরিবর্তন ছিল অর্থমন্ত্রী বদল। আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা ১০ বার বাজেট দিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে নতুন অর্থমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের নতুন যে বাজেটটি দিলেন, তার উপস্থাপনায় খানিকটা নতুনত্ব ছিল। দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা তৈরির যে রেওয়াজ সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত করে গেছেন, নতুন অর্থমন্ত্রীও তা অনুসরণ করেছেন। নতুন যা ছিল তা হচ্ছে, শুরুতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও অর্জন নিয়ে দেখানো একটি প্রামাণ্যচিত্র। তবে অর্থমন্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেরই বাজেট বক্তৃতার অনেকখানি অংশ পাঠ করেন, যা আগে কখনো হয়নি।

বাস্তবায়নে ব্যর্থতা

দেবযানী কচকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিল, ‘...সে বিদ্যা তোমার/ সম্পূর্ণ হবে না বশ—তুমি শুধু তার/ ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ;/ শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।’

অর্থমন্ত্রী গতকাল প্রথা মেনে বাজেট সংশোধনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায়-অভিশাপ’ কবিতাটিরই প্রতিফলন মনে করা যায়। কেননা, আওয়ামী লীগ সরকারের রয়েছে টানা ১১টি বাজেট দেওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের কাজ থেকে তিনি দূরে ছিলেন না। অথচ এবারও বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেল না। বরং শুরুতে বড় আকারের বাজেট দেওয়া, শেষ দিকে সংশোধন, তারপর আরেক দফা সংশোধন—বছরের পর বছর ধরে চলা এই ধারা এবারও দেখা গেল। অর্থাৎ ১০ বছর ধরেই আছে বড় বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু এর প্রয়োগ কখনো দেখা গেল না।

কেন বাজেট সংশোধন? অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ছোট করে বলেছেন, ‘রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কিছুটা কম হবে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।’ এ জন্য তিনি চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছেন ২২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। তবে রাজস্ব আয়ের যে পরিস্থিতি, তাতে শেষ পর্যন্ত ঘাটতি আরও অনেক বেশি হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাতে অর্থবছর শেষে করতে হবে আরেক দফা সংশোধন।

বাজেট সংশোধন হয়েছে ব্যয়ের দিক থেকেও। রাজস্ব ব্যয় কমানো হয়েছে ২২ হাজার ৩২ কোটি টাকা, আর উন্নয়ন বাজেট কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের উৎস ব্যবহারের দিক থেকেও ছিল ব্যর্থতা। যেমন লক্ষ্য ছিল ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক সাহায্য সূত্রে পাওয়া যাবে ৫০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৪৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। আবার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল উৎস সঞ্চয়পত্র বিক্রি করবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার। অথচ লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার। এর মধ্যে আয় করতে পারছে ৩ হাজার ২০ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা, ফলে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা।

নতুন বাজেট

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে আয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। যত সমস্যা এই ঘাটতি অর্থায়নেই। অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা, তিনি ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাবেন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এমনিতে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে আছে ব্যাংক খাত। নগদ অর্থ নেই তাদের কাছে। ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। অথচ সেখানেই ভাগ বসানোর বড় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছেন অর্থমন্ত্রী। এতে সফল হলে নিশ্চিতভাবে বঞ্চিত হবে বেসরকারি খাত।

বাজেট ঘাটতি পূরণের সর্বশেষ উৎস হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। শেয়ারবাজারে আস্থা নেই, ব্যাংকে রাখলে সুদ কম। এই সমস্যা থেকে মুক্ত সঞ্চয়পত্র, এটি নিরাপদ ও লাভজনক। তাই সাধারণ মানুষ কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সরকারের লক্ষ্য, এবার এই উৎস থেকে আসবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত তা আরও বাড়তে পারে।

>

মোট ব্যয় ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা
মোট আয় ৩,৮১,৯৭৮ কোটি টাকা
ঘাটতি ১,৪১,২১২ কোটি টাকা

নতুন অর্থমন্ত্রীর দেওয়া নতুন বাজেটও বিশাল। তবে এর পেছনের গল্পটি আশাব্যঞ্জক নয়। কেননা, বিশাল এই বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হবে অনুৎপাদনশীল খাতে। যেমন বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হবে রাজস্ব বাজেটের ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ, পেনশন দিতে যাবে আরও ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে বরাদ্দের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতিবছর বড় বাজেট পেশ করলেও ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যয়বহুল উৎস থেকে ঋণ করেই যাচ্ছে। আর এর পরিণতিতে সুদ পরিশোধ ব্যয়ে লাগাম টানা যাচ্ছে না। নতুন অর্থমন্ত্রীও একই পথে হাঁটলেন।

কী আছে বাজেটে

অর্থমন্ত্রী হয়ে প্রথম বাজেটে বড় ধরনের উচ্চাভিলাষ দেখাননি আ হ ম মুস্তফা কামাল। আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবতার কাছাকাছি। বাজেট বাস্তবায়নে কিছু সমস্যার কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন। কিছু স্বপ্নপূরণের কথাও বলেছেন। তবে স্বপ্নপূরণের পথটা ঠিকঠাক বলেননি।

তবে কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি শুরুতেই বলেছেন, বাজেটটিতে দেশের জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে, তেমন কোনো উপকরণ রাখা হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হবে, সেটাই দেখার বিষয়।

কর-জিডিপির অনুপাত যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম, সে কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি মনে করেন, দেশে ৪ কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আয়কর দেয় মাত্র ২১-২২ লাখ। তিনি দ্রুত সময়ে এই সংখ্যা ১ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আগেই বলা ছিল, অর্থমন্ত্রী নতুন ভ্যাট আইন চালুর ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে এতে কার ঘাড়ে কতটা বোঝা বাড়বে বা কমবে, তা বলা হয়নি, কাটেনি অনেক অস্পষ্টতা। মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও করমুক্ত আয়ের সীমায় কোনো বদল আনা হয়নি। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির যুগে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বপ্নও দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে কীভাবে তা সম্ভব করা হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই।

অর্থমন্ত্রী সবাইকে খালি হাতে ফেরাননি। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্টআপ তহবিলে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে রাজনৈতিক চাপের মুখে শিক্ষা খাতে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন, সামাজিক খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে, প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিতে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, শস্যবিমা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসব উদ্যোগ বিশাল বাজেটের তুলনায় হয়তো বিশাল কিছু না, তবে রবীন্দ্রনাথের গানটির মতো বলাই যায়, ‘অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া,/ সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া।’

অবশ্য নতুন বাজেটে খুশি হবেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা, পোশাক রপ্তানিতে পাবেন প্রণোদনা। উচ্চবিত্তরাও পেলেন অনেক কিছু। নাগরিকেরা আয়কর দেন না—এই অনুযোগ করেও সম্পদের ওপর ধার্য করা সারচার্জ কমালেন। এমনকি কালোটাকার মালিকেরাও পাচ্ছেন নতুন সুবিধা। সব মিলিয়ে অর্থমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী ও সামর্থ্যবানদের পক্ষেই বেশি থাকলেন।

অর্থমন্ত্রীর প্রথম ইনিংসটিতে ছন্দপতন ঘটল। পুরোটা পড়তে পারলেন না। সুস্থ হয়ে মাঠে নেমে ঘাটতিটা পুষিয়ে দেবেন—এটাই এখন প্রত্যাশা। তবে এর আগে স্বীকার করে নিতে হবে অর্থনীতির বিদ্যমান নানা সংকটের কথা। মানতে হবে ব্যাংক খাতের মহাসংকটের কথা। অনুভব করতে হবে কৃষকের দর না পাওয়ার বেদনাটা। বুঝতে হবে সাধারণ মানুষের আসল চাওয়া-পাওয়া। সংগতি কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী যেমনটি বলেছেন, ‘তোমার আমার নানা সংগ্রাম,/ দেশের দশের সাধনা, সুনাম,/ ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিণাম/ মেলাবেন।’

অর্থমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত কতটা মেলাতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে বাজেটের সাফল্য ও ব্যর্থতা।