সরকারি ঋণ ব্যাংকের সংকট আরও বাড়াবে

বাজেটের বিশাল ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের পরিকল্পনা দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র তারল্যসংকটে আছে বেশির ভাগ ব্যাংক। আর এ সময়ে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা পেশ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অর্থ বেশি ধার করলে বেসরকারি খাত বঞ্চিত হবে। কেননা, সব টাকা সরকার নিয়ে গেলে বেসরকারি খাতের জন্য আর অবশিষ্ট থাকবে না। সরকারের জন্য দ্বিতীয় পথ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করা। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন করে টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করেছেন, তাতে ব্যাংক খাতের সংকট কাটাতে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগের কথা নেই। বরং আছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা এবং শিল্পঋণে এক অঙ্কের সুদ হার বাস্তবায়নের ঘোষণা। এ দুই কারণে তারল্যসংকট আরও উসকে যাবে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। এমনিতেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অনেক কমে ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে নেমেছে।

বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন আইন সংশোধনের কথাও বলেছেন। আবার ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, আর কারা প্রকৃত খেলাপি, এটা বড় প্রশ্ন হিসেবে আসবে।

  • ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে বাজেটে
  • এতে সমস্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান এসব বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে জিডিপির অনুপাতে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লাগবে। এমনিতেই ব্যাংকগুলোতে টাকা নেই। সুদহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখন যদি সরকারও ব্যাংক খাত থেকে টাকা নেয়, তাহলে বড় চাপ হয়ে যাবে। আবুল কাশেম খান আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে কেউ নতুন করে বিনিয়োগে সাহস করবেন না। যাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁরাও অপেক্ষা করবেন।

অর্থায়ন পরিকল্পনা

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে গত ২৯ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ১৮ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়নের আরেকটি উৎস হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। মুনাফার হার বেশি বলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিকল্পনা ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার। কিন্তু গত মার্চ পর্যন্ত নিট বিক্রির পরিমাণ ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, বিক্রি আরও বাড়বে।

সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলেও তা দুই ধরনের বিপদ সৃষ্টি করে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেশি বলে ব্যাংকে টাকা না রেখে এই খাতে বিনিয়োগ বেশি হয়। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যায়, যা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাংক এখন হন্যে হয়ে আমানত খুঁজছে। ফলে আমানতের সুদের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার বলছে, আমানতের সুদহার রাখতে হবে ৬ শতাংশ আর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ।

সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রির আরেকটি বিপদ হলো এতে সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে এভাবে ব্যয়বহুল ঋণ নেওয়ার ফল হচ্ছে এখন বাজেটে সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দ হচ্ছে মোট ব্যয়ের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার নিয়েছিল ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর আগে যখন ব্যাংকে টাকা ছিল, তখন সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে টাকা তুলেছে। তবে এখন ভুল সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কারণ, ব্যাংকে টাকা নেই, ধার করলে তারল্যসংকট আরও ঘনীভূত হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া মানে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি থাকে। আগুনে তেল দেওয়ার মতো এটা বড়ই বিপজ্জনক পথ। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা থাকলে এতে সমস্যা হতো না।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে সংকট চলছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা বাজেটে নেই। খাতটি ঠিক করতে ঋণখেলাপিদের ধরতে হবে, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ডলারের দাম ধরে না রেখে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, এতেও তারল্যসংকট কিছুটা কমবে। বড় প্রশ্ন হলো, যেখানে অর্থনীতি এত ভালো, কৃষি উৎপাদন ভালো, সেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধি কেন কমছে।

টাকার পেছনে ছুটছে ব্যাংক

এদিকে টাকার সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেই দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে অনেক বেসরকারি ব্যাংক। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়া হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংকের হাতে বিনিয়োগ করার মতো টাকা আছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট পেশের পরে নতুন করে আমানতের পেছনে ছুটতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। তারল্য সংগ্রহে অনেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এতে ঋণের সুদহার প্রতিনিয়ত বাড়ছেই, যা ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই ব্যাংকে টাকা নেই। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিও প্রতি মাসে কমছে। আবার যদি সরকার ব্যাংক থেকে টাকা নেয়, তাহলে ব্যাংকের ওপর বড় চাপ তৈরি হবে। তাহলে আমরা যে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি চাইছি, তা বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন করে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না।’

এদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ মানির যে লক্ষ্য ধরেছিল, সরকার টাকা ধার করায় তা লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। চলতি জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মানির (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বৈদেশিক সম্পদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমষ্টি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ধরেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, গত এপ্রিলেই তা ৬ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এর ফলে গত এপ্রিলে ব্রড মানির (জনগণের হাতে থাকা নোট, তলবি ও মেয়াদি আমানতের সমষ্টি) প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ। চলতি জুন পর্যন্ত যার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই, এ জন্য সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করবে। ব্যাংক থেকে টাকা নিলে সংকট আরও বাড়বে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার দেওয়া মানে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া। তারল্য বাজারে এর চার গুণ প্রভাব পড়ে। এতে মূল্যস্ফীতি উসকে যেতে পারে। চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সবশেষে তিনি বলেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে রাজস্ব আদায়ে জোর দিতে পারত। এ জন্য রাজস্ব বোর্ডে বড় ধরনের সংস্কার ও উদ্যোগ প্রয়োজন।