জমিতে নয়, ব্যাংকে নিয়ে আসা হোক কালোটাকা

মানোয়ার হোসেন
মানোয়ার হোসেন

প্রস্তাবিত বাজেটকে এককথায় বললে বলতে হয়, একটি ধাঁধার মতো বাজেট হয়েছে। মনে হয়েছে, সবাইকে খুশি করতে গিয়ে কাউকে খুশি করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। আগে বাজেটের ব্যয়টাকে ঠিক করা হয়েছে, তারপর আয় নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা হয়, তাতে বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্ন খাতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আয় বুঝে ব্যয় না করে বরং ব্যয়টাকে চূড়ান্ত করার পর আয় ঠিক করতে গিয়ে কোনোভাবে হিসাব মিলিয়ে একটা বাজেট করা হয়েছে। বাজেটে সরকারের খরচ কমানোর কোনো প্রস্তাব নেই। তবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি অর্থাৎ আমাদের ব্যবসায়ীদের ওপর কর বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

তবে বাজেটে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগও আছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ওপর ২ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগটি খুবই ইতিবাচক। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থাৎ বৈধপথে আগের চেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসবে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে যাঁরা প্রবাসে কাজ করছেন, তাঁদের শ্রমের প্রতিও একধরনের সম্মান জানানো হবে। কৃষি নিয়ে কিছুটা কাজ শুরু হয়েছে। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে হয়তো নতুন রূপ নেবে। বাজেটে কৃষকদের জন্য ভর্তুকি রাখা হলে আরও ভালো হতো। কারণ, কৃষক যদি না বাঁচে তাহলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। তাদের জন্যই খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি আমরা।

প্রস্তাবিত বাজেটে জমি, ফ্ল্যাট, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জমিতে বিনিয়োগ মানে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ। কালোটাকা জমিতে গেলে জমির দাম আরও বেড়ে যাবে। তখন সৎ ব্যবসায়ীদের জমি কিনতে বাড়তি দাম গুনতে হবে। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ–সুবিধা থাকবে। রাস্তাঘাট, গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সেখানে কালোটাকা বিনিয়োগের সুবিধা দিলে অনেক ভালো ব্যবসায়ী বঞ্চিত হবেন। তাই কালোটাকা জমি, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগের সুযোগ না দিয়ে তারল্যসংকট নিরসনে ব্যাংকে নিয়ে আসা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার তিন মাসের সময় দিয়ে বলতে পারে, কালোটাকা ব্যাংকে তিন বছরের জন্য স্থায়ী আমানত করলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।

বাজেটে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও কালোটাকা তৈরির উৎস বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেই। উল্টো বিভিন্ন খাতে কর বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর করের চাপ বেড়ে যাবে। আমরা ব্যবসায়ীরা দুই দিন পরপর মরতে থাকব, আর যাঁরা কর দিচ্ছেন না, তাঁদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হবে। সরকারের বাস্তবতা বোঝা উচিত।

অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই করপোরেট কর কমানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত হয়তো বাজেট মেলাতে না পেরে করপোরেট কর কমানো হয়নি। এভাবে রাজস্ব আদায় বাড়াবে না। ব্যবসায়ীদের চাপে রেখে অর্থনীতির উন্নতি হবে না। ব্যাংক খাতের সংস্কারের কথা বলা হলেও এ জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পথনকশা নেই। বাজেটের টাকা দিয়ে সরকারি ব্যাংকের লোকসান মেটানো ঠিক হবে না। বরং রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। তাতে অনেক পণ্যেই করের বোঝা বাড়বে। তবে খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট দেওয়ার পক্ষে নই আমি। প্রতিটি পণ্যেই কোনো না কোনো পর্যায়ে ভ্যাট দেওয়া আছে। কারও না কারও আয়কর দেওয়া আছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় যেখানে ১ হাজার ৯০৯ ডলার সেখানে কতটুকু করের বোঝা চাপাবেন সেটি দেখা উচিত। সব থেকে বড় বিষয়, জনগণ খুব কষ্ট করে কর দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থের অপচয় হচ্ছে। সেখানে সরকারের আরও বেশি নজর দেওয়া দরকার।

বাজেটের পর অনেকেই বলেছেন, নতুন কিছু নেই। কিন্তু বাজেটে নতুন অনেক কিছুই আছে। ব্যবসায়িক জীবনে প্রথম শুনলাম, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভের ওপর কর বসানো হবে। একটা কোম্পানি কখন রিজার্ভ বাড়ায়? কোম্পানির ভিত শক্তিশালী করতে। আবার বোনাস শেয়ারের ওপরও বাড়তি করের বিধান করা হয়েছে। শেয়ারবাজারের লোকজনকে খুশি করার জন্য এটি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কতটা ভালো হবে তা যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

মানোয়ার হোসেন ,চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস সমিতি