করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ায় চাপ বাড়বে করদাতার

মাসুদ খান
মাসুদ খান

সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা চার বছর ধরে আড়াই লাখ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। সর্বশেষ এ করমুক্ত আয়সীমাটি পরিবর্তন করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি সর্বনিম্ন করের হারও ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে। ফলে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর যে প্রত্যাশা ছিল, তা আশার আলো দেখেনি। বাজেট বক্তব্যে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান এ সীমা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু গড় আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হিসাব করলে দেখা যায়, চার বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এ মূল্যস্ফীতির হিসাবকে বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা ন্যূনতম ২৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা দরকার ছিল।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ রুপি, বর্তমান বিনিময় হারে বাংলাদেশি টাকায় যা ৩ লাখ টাকার সমতুল্য। দেশটিতে সর্বনিম্ন করহার ৫ শতাংশ। পাকিস্তানে করমুক্ত আয়ের সীমা ৬ লাখ পাকিস্তানি রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সোয়া ৩ লাখ টাকার সমান। পাকিস্তানেও সর্বনিম্ন করহার ৫ শতাংশ। থাইল্যান্ডে করমুক্ত আয়ের সীমা দেড় লাখ থাই বাথ, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ লাখ ৮ হাজার টাকার মতো। সেখানেও সর্বনিম্ন করের হার ৫ শতাংশ। আর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যে করমুক্ত আয়ের সীমা ১২ হাজার পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার মতো।

মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও বাড়িভাড়া, পরিবহন ভাতা ও চিকিৎসা ভাতার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির পরিমাণ আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরেও আগের মতোই রাখা হয়েছে। খরচ বেড়ে গেলেও কর ছাড়ের হার একই থাকার কারণে দিন শেষে করদাতাদের উচ্চ হারে কর পরিশোধ করতে হবে। দক্ষ জনশক্তির বিকাশের জন্য শিক্ষা অন্যতম পূর্বশর্ত হলেও এবারের কর আইনেও শিক্ষা ভাতার ওপর কোনো কর ছাড় দেওয়া হয়নি।

এবারের অর্থ বিলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বোনাস লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে কর আরোপের প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে এ ধরনের কর প্রস্তাব করা হয়েছে। বোনাস লভ্যাংশ শেয়ারধারীদের সম্পদে কোনো ধরনের মূল্য সংযোজন করে না। আমরা জানি, শেয়ারবাজারে বোনাস লভ্যাংশের অনুপাত হিসাব করে শেয়ারের মূল্য সমন্বয় করা হয়। কীভাবে বোনাস লভ্যাংশের কর আদায় করা হবে, সেটিও অস্পষ্ট। ধরা যাক, কোনো কোম্পানি ১০০টি বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাহলে কি কোম্পানিটি কর বাবদ সেখান থেকে ১৫টি শেয়ার রেখে দিয়ে বাকিগুলো শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে?

এদিকে আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন ভ্যাট আইন দেশের সাধারণ মানুষের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বিদ্যমান ভ্যাট আইনে ভোক্তাদের ছাড় দেওয়ার জন্য শুল্ক মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ৮৪টি পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়, তাতে বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় হয়। নতুন আইনে লেনদেন মূল্যের ওপর একাধিক হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রীর ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তাতে প্রসাধনী, মুঠোফোন সেবা, সিরামিক, সিগারেট, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, রান্নার তেল, ওষুধ, বিয়ে, গণমাধ্যম কেন্দ্র, আইসক্রিম, যানবাহন নিবন্ধন, যানবাহন, নাটক, চলচ্চিত্র, দুধ, চিনি, সুগন্ধি, চুলা, বয়লার, স্মার্টফোন, রাইড শেয়ারিং ও অনলাইন কেনাকাটায় খরচ বেড়ে যাবে। আর তাতে দিন শেষে সাধারণ মানুষেরই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। আবার উৎসে আয়কর-সংক্রান্ত বিধান পরিবর্তনের কারণে সিমেন্ট ও স্টিলের দাম বাড়বে।

তবে এ কথা সত্য, যখন দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশের কম কর প্রদান করে, তখন কর আদায় বাড়াতে কোনো যুক্তিতর্কই কাজ করে না। এমন পরিস্থিতিতে করের আওতায় থাকা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ কীভাবে জীবনযাত্রা ও করে চাপ মোকাবিলা করবে, সে চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত।