ভ্যাটের চাপ, গ্যাসের আগুন

নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এক কেজি সুতার দাম বাড়বে ছয় থেকে আট টাকা। এই সুতায় তৈরি বস্ত্র যখন পোশাক হয়ে ব্র্যান্ডের দোকানে উঠবে, তখন মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) দিতে হবে আগের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। এ টাকাটা ব্যবসায়ী তাঁর পকেট থেকে দেবেন না, দেবেন ক্রেতা।

সুতা একটি উদাহরণ। এমন উদাহরণ আরও আছে। আগামী মাসের বাসাভাড়ার সঙ্গে ১৭৫ টাকা বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা গ্যাস বিল দিতে হবে ভাড়াটেদের। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়তে পারে ভোজ্যতেল, চিনি, আটা-ময়দা ইত্যাদির দাম। বস্ত্রকল, রড ও সিরামিকের মতো শিল্প উচ্চমাত্রায় গ্যাস ব্যবহার করে। তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও বেশি হবে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের পরিবহন ব্যয় বাড়তে পারে।

ভ্যাট ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্তরে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়বেন তাঁরা, যাঁদের আয় বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ তালিকায় শ্রমিক, চাকরিজীবী ও পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া কৃষকের নাম থাকবে সবার ওপরে।

গ্যাসের দামের কারণে রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা আরেকটু কঠিন হতে পারে। আবার দেশে উৎপাদন খরচ বাড়লে বিদেশি পণ্য আমদানি বাড়তে পারে। যেমন, সুতা। বিদেশি সুতার কারণে সব সময়ই একটি চাপে থাকে দেশীয় বস্ত্রকলগুলো।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বাজেটে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা, রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ এবং গ্যাসের দামের অভিঘাত সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষের ওপর তুলনামূলক বড়ভাবে পড়তে পারে। বিপরীতে সীমিত আয়ের মানুষকে ছাড় দেওয়ার যে সুযোগ থাকতে পারত, সে ধরনের উদ্যোগ বাজেটে তেমন নেই। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি যে হারে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা ধরে রাখা কঠিন হবে।

অবশ্য গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, সিপিডি গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের পক্ষে ছিল। সরকার যেভাবে বাড়াচ্ছে, যতটা বাড়াচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

১০ বছরে ৭ বার
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১০ বছরেরও বেশি সময়ে সাতবার গ্যাসের দাম বেড়েছে। অবশ্য প্রতিবারই সব খাতে বৃদ্ধি করা হয়নি। প্রথম দফায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন দায়িত্ব নেয়, তখন বাসাবাড়িতে দুই চুলার গ্যাসের দাম ছিল ৪৫০ টাকা। এখন সেটা ৯৭৫ টাকা।

২০০৮ সালে প্রতি ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম ছিল ১৬ টাকা ৭৫ পয়সা। নতুন করে বাড়িয়ে এখন সেটা ৪৩ টাকা করা হলো। এবারের গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির হারই সর্বোচ্চ, গড়ে প্রায় ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ।

সুতার দাম বাড়বে ৮ টাকা
ক্যাপটিভ গ্যাস জেনারেটরে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ দশমিক ৮৫ টাকা হয়েছে। ৫৮৫টি বস্ত্রকলে ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সে জন্য গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বস্ত্র খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে খরচ ৬ থেকে ৮ টাকা বাড়বে বলে জানান বস্ত্রকল ব্যবসায়ীরা।

>

নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কার মধ্যে বাড়ল গ্যাসের দাম
ভ্যাট ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে
চাপে শিল্প খাত, বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষ

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে তিন দফায় ক্যাপটিভ গ্যাস জেনারেটরে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। এবার গ্যাসের দাম ১০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেলে বস্ত্রকল সইতে পারবে না। তাই আমরা ধাপে ধাপে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’

রডে টনপ্রতি প্রভাব ১,৪০০ টাকা
গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে রডের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ ছাড়া বাজেটে রডের কাঁচামাল থেকে উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট ও অগ্রিম কর আরোপ করায় টনপ্রতি বাড়তে পারে ১০ হাজার ৯২৫ টাকা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে রডের দাম টনপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে তা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, বাজেটে রডের কাঁচামাল থেকে উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে যে হারে ভ্যাট ও কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাতে খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি। নতুন করে আবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। এতে করে রডের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

টাইলসে ৩৪ টাকা এখন ৪৭ টাকা
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সহসভাপতি মো. মামুনুর রশিদ বলেন, আগে প্রতি বর্গমিটার টাইলস উৎপাদনে ৩৪ টাকার গ্যাস লাগত। এখন ব্যয় দাঁড়াবে সাড়ে ৪৭ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এখন দাম বাড়াই, তাহলে চীনা টাইলস আমদানিতে সুবিধা হবে। আমদানিকারকদের জন্য গ্যাসের দামের কোনো প্রভাব থাকে না।’

সিরামিক উদ্যোক্তাদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন হিসাব দেন, গড়ে একটি তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যয় বাড়বে সাড়ে ৪ শতাংশ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ভোজ্যতেল, চিনি পরিশোধনে বয়লার চালাতে হয়। এ জন্য গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। গ্যাসের পেছনে ব্যয় প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়লে পণ্যমূল্যের ওপর প্রভাব পড়ে।

এবারের বাজেটে কর প্রস্তাবের কারণে চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা ও তেলের দাম ৩ টাকা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

ক্যাব যাবে আদালতে
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানো অপরিহার্য ছিল না। সে রূপরেখা আমরা দিয়েছি। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, দেশের ১২ কোটি মানুষ সীমিত আয়ের। তাদের ওপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভোগব্যয় কমবে। যা আবার শিল্প, রাজস্ব আদায় ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট চলমান আছে। নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি আদালতে তোলা হবে। প্রতিকার চাওয়া হবে।

সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা এখানেই শেষ নয়। দেশে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় গ্যাস থেকে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাও আসতে পারে।