সিমেন্টের চাহিদা বাড়াচ্ছে বড় অবকাঠামো প্রকল্প

খন্দকার কিংশুক হোসেইন
খন্দকার কিংশুক হোসেইন

প্রথম আলো: সিমেন্ট ব্যবসা এখন কেমন যাচ্ছে? দেশে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে সিমেন্ট খাতের ওপর কি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে?

কিংশুক হোসেইন: অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়লে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ে। কারণ, ভৌত অবকাঠামো তৈরির মূল উপকরণ সিমেন্ট ও রড। এখন সিমেন্ট খাতের ব্যবসা মোটামুটি ভালো। বিক্রির প্রবৃদ্ধিও দুই অঙ্কে রয়েছে। এমনিতে বছরে গড়ে ১০-১২ শতাংশ হারে বিক্রি বাড়ে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬ শতাংশ।

প্রথম আলো: বসুন্ধরার সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা কেমন?

কিংশুক হোসেইন: বসুন্ধরার দুটি ব্র্যান্ড। একটি কিং ব্র্যান্ড সিমেন্ট। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশীয় মালিকানার বেসরকারি খাতের প্রথম মিল মেঘনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে কিং ব্র্যান্ডের সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। পরে আমরা বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অধীনে বসুন্ধরা সিমেন্ট বাজারে নিয়ে আসি। এখন আমরা দিনে ১৪ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা রাখি, যা দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ১৫ শতাংশ। সক্ষমতা যা, উৎপাদনও প্রায় সমান। বাজারে বিক্রির দিক দিয়ে আমরা কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় অবস্থানে থাকি।

প্রথম আলো: যেহেতু আপনারা উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় সমান সিমেন্ট উৎপাদন করেন, সেহেতু নতুন করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো তো জরুরি হয়ে পড়েছে?

কিংশুক হোসেইন: আগামী নভেম্বর থেকে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা ১০-১১ হাজার টন বাড়বে। এর ৭ হাজার টন যোগ হবে মেঘনা সিমেন্ট মিলসের কিং ব্র্যান্ডে। বাকি চার হাজার টন যোগ হবে বসুন্ধরায়। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে আমরা নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছি।

প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন, বড় অবকাঠামো সিমেন্টের চাহিদা বাড়ায়। আপনাদের কোম্পানির ক্ষেত্রে বড় প্রকল্প কীভাবে চাহিদা বাড়িয়েছে?

কিংশুক হোসেইন: আমি সুনির্দিষ্ট করে বলি, পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সিনো হাইড্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা শুরু থেকে এককভাবে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করছে। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে আবদুল মোনেম লিমিটেড এককভাবে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করেছে। মূল সেতু নির্মাণে একমাত্র দেশীয় কোম্পানি হিসেবে বসুন্ধরার সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাইরে একটি বিদেশি কোম্পানির সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে।

ঢাকার উড়াল সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে শতভাগ বসুন্ধরা সিমেন্ট দিয়ে। মেট্রোরেল প্রকল্পেও একমাত্র বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। মিরপুর ডিওএইচএস-ইসিবি চত্বরে যে ফ্লাইওভার হবে, সেটিতে সিমেন্ট সরবরাহের চুক্তি সই করেছে বসুন্ধরা। মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পেও বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামে এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পেও বসুন্ধরা সিমেন্ট সরবরাহ করছে। এর বাইরে আরও অনেক প্রকল্পে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রথম আলো: এসব প্রকল্পে কি বিশেষ কোনো সিমেন্ট দরকার হয়, নাকি বাজারে আমরা যা কিনি, সেই সব সিমেন্টই সরবরাহ করেন?

কিংশুক হোসেইন: সিমেন্টের দুটি প্রকার আছে, পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট (পিসিসি) ও অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট (ওপিসি)। ওপিসিতে ৯৫ শতাংশ ক্লিংকার থাকে আর দেড় শতাংশের মতো জিপসাম থাকে। পিসিসি সিমেন্টে ক্লিংকার তুলনামূলক কম থাকে। যে প্রকল্পে যে ধরনের সিমেন্টের চাহিদা আছে, সেই প্রকল্পে সেই ধরনের সিমেন্ট দেওয়া হয়। প্রকল্পগুলোর প্রকৌশলীরা সিমেন্টের প্রতিটা চালান পরীক্ষা করেন। মান ঠিক থাকে বলেই তাঁরা আমাদের সিমেন্ট ব্যবহার করেন।

প্রথম আলো: আপনারা যে বিভিন্ন বড় প্রকল্পে সিমেন্ট সরবরাহের কাজ পান, সেটা কীসের ভিত্তিতে?

কিংশুক হোসেইন: বড় প্রকল্পগুলোতে সিমেন্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় দেখা হয়। প্রথমত, কাঁচামালের মান কী রকম। সিমেন্টের ক্লিংকারে মানগত পার্থক্য থাকে। দ্বিতীয়ত দেখা হয়, সিমেন্টের কাঁচামাল সংগ্রহের সক্ষমতা কেমন। তৃতীয়ত, কোম্পানির সক্ষমতা কেমন। এ ছাড়া লজিস্টিকস সক্ষমতা ও বিপণন কৌশলের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আপনি যদি সঠিক কাঁচামাল ব্যবহার না করেন, তাহলে মান একেক দিন একেক রকম হবে। বড় প্রকল্পে সরবরাহের ক্ষেত্রে মান একই থাকতে হবে এবং ধারাবাহিক সরবরাহের সক্ষমতা থাকতে হবে। কাঁচামাল আমদানিতে আমাদের নিজস্ব জাহাজ (মাদার ভেসেল) আছে। পরিবহনের জন্য আমাদের বাল্ক ক্যারিয়ার আছে ১৯০টি, ট্রাক আছে ৪০০টি।

প্রথম আলো: বাজারে একটি কথা প্রচলিত আছে যে আপনারা খুব আগ্রাসী বিপণন কৌশলে কাজ করেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?

কিংশুক হোসেইন: এটা তো ভালো। আগ্রাসী বিপণন কৌশল বলতে আমি বুঝি, আমাদের পণ্য গ্রাহকের সামনে তুলে ধরা। আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে, ব্যবহারকারীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিই। রাজমিস্ত্রিদের প্রশিক্ষণ দিই। পণ্য সম্পর্কে তথ্য দিই, সত্যিকার তথ্য। আপনি দেখবেন, অনেকেই বলে তারা পদ্মা সেতুর গর্বিত অংশীদার। আসলে তাদের সিমেন্ট পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হয় না।

প্রথম আলো: সিমেন্টের বাজারের ভবিষ্যৎ কী?

কিংশুক হোসেইন: ভবিষ্যৎ বেশ ভালো। আগামী দিনে আরও কমপক্ষে ২০ বছর সিমেন্টের বাজারে প্রবৃদ্ধি থাকবে। এর কারণ, বাংলাদেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার এখনো কম। এটা বছরে এখন ১৭০ কেজি। ভারত ও পাকিস্তানেও সিমেন্টের ব্যবহার অনেক বেশি।