কয়েলের বাজার ছাড়ছে বড়রা

কয়েক বছর আগেও দেশের মশার কয়েলের বাজারে সবচেয়ে বেশি হিস্যা ছিল মরটিন ব্র্যান্ডের। কিন্তু এ ব্র্যান্ডের কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেকিট অ্যান্ড বেনকাইজার তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। উৎপাদন বন্ধ করেছে এ বাজারের আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এসিআইও।

কয়েল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, দেশে এখন অবৈধ ও নামকাওয়াস্তে শত শত কয়েল কারখানা গড়ে উঠেছে, যারা ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করে কয়েল উৎপাদন করে। যেটা কমপ্লায়েন্ট বা সার্বিক মানসম্পন্ন কারখানাগুলো করতে পারে না। এতে তারা বাজার হারিয়েছে। কোম্পানিগুলোর দাবি, কয়েল উৎপাদনে কোন রাসায়নিক কী মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। এটা অখ্যাত ও অবৈধ কারখানা মানে না। উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করা কয়েল মশা তাড়ায় ঠিকই, কিন্তু সেটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।   

জানতে চাইলে এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘কয়েলের বাজারে এখন দুষ্টদের রাজত্ব চলছে। আমরা চাইলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কয়েল উৎপাদন করে বাজারে ছাড়তে পারি না। তাই উৎপাদনই বন্ধ করে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক নিয়ম মানতে হয়। কর দিতে হয়। ওই সব কারখানার ক্ষেত্রে তো কিছুই লাগে না। সরকার দেখুক, এ খাত থেকে আগে কত কর আসত, এখন কত আসে।’

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের কয়েলের বাজারের আকার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ বাজারে ২০১২ সালেও প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের হিস্যা ছিল ৫৫ শতাংশের বেশি। এখন সেটা কমে ১২-১৩ শতাংশে নেমেছে। সমস্যা শুরু হয় মূলত ২০১২ সালের দিকে। প্রথমে চীন থেকে প্রচুর অনুমোদনহীন কয়েল বাজারে আসা শুরু করে। এরপর দেশেই শত শত কারখানা গড়ে ওঠে।

বাজারে রেকিট অ্যান্ড বেনকাইজারের মরটিন, এসিআই, ভারতের গোদরেজের গুডনাইট, কাজী এন্টারপ্রাইজের ইগল, গ্লোবসহ আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড সুপরিচিত ছিল। এখন বেশির ভাগই বাজার হিস্যা হারিয়েছে। কয়েকটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

>

কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে মরটিন
উৎপাদন বন্ধ এসিআইয়ের
হারিয়ে গেছে অনেকে
বাজারে বড়দের হিস্যা ৫৫% থেকে কমে ১৫ %

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কীটনাশক ও তার ব্যবহার শীর্ষক নির্দেশনায় মশার কয়েলে ছয়টি রাসায়নিক নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও তা অনুসরণ করা হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একটি কোম্পানি দেশের বাজারের অখ্যাত ১৪টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল পরীক্ষার জন্য ভারতে পাঠায়। এতে দেখা যায়, এসব কয়েলে মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ১৪ গুণ বেশি রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, যেকোনো একটি রাসায়নিক ব্যবহারের কথা থাকলেও প্রয়োগ করা হচ্ছে চারটি পর্যন্ত। 

এর আগে ২০১৫ সালে জাপানের সুমিতমো কেমিক্যালের কাছেও ২৪টি কয়েলের নমুনা পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। তাতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হারে এবং আইন ভেঙে একাধিক রাসায়নিক ব্যবহারের চিত্র পাওয়া যায়।

একটি কোম্পানির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, এসব কারখানা গড়ে উঠেছে যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায়। ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা এসব কারখানার কোনো পরীক্ষাগার নেই, কোনো রসায়নবিদ নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কয়েলের ব্যবসা ধরে রাখতে কোনো বিদেশি ব্র্যান্ড অনৈতিক ও বেআইনি কাজ করে নিজেদের সুনামের ক্ষতি করবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, কয়েল মশা তাড়ানোর জন্য, মারার জন্য নয়। এতে কী মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ হবে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমদানি করা ও নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েলে রাসায়নিক দেওয়া হয় হিসাব-নিকাশ ছাড়া। এতে তেলাপোকা, টিকটিকিও মরে যায়।

কবিরুল বাশার আরও বলেন, দেশের মানুষ শুধু নগদ লাভ খুঁজে ক্ষতিকর কয়েল ব্যবহার করছে। এতে স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।