সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিভ্রান্তি, ঠকছেন সাধারণ মানুষ

সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর কর আরোপ নিয়ে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর গ্রাহকেরা বারবার বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। বাজেট উপস্থাপনের দিন গত ১৩ জুন থেকেই মূলত এ বিভ্রান্তির শুরু। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তব্যে কর আরোপ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু একই দিন অর্থবিলে সব সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়, আগে যা ছিল ৫ শতাংশ। এ নিয়ে সংসদে এবং বাইরে সমালোচনা হলেও এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই বাজেট পাস করা হয়।

ফলে উৎসে কর ১ জুলাই থেকে আরোপ হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, এত দিন ৫ শতাংশ উৎসে কর দিয়ে যাঁরা মুনাফা পাচ্ছিলেন কিন্তু মুনাফা তোলেননি, তাঁদের কত শতাংশ কর দিতে হবে? সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই বিভ্রান্তিও কাটেনি।

এ কারণে জুনের শেষ ১৫ দিন বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাকঘরসহ সব জায়গায় ছিল বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের ভিড়। এমনকি গ্রাহকদের টাকা দিতে রাত ১০টা পর্যন্তও অফিস খোলা রাখতে হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, অস্পষ্ট প্রজ্ঞাপনগুলোর কারণে প্রতিবার ভোগান্তি পোহাতে হয়। অথচ দুটি লাইন বাড়িয়ে লিখলেই স্পষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করা সম্ভব।

আবার, বাজেট পাসের পর জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায়, নতুন-পুরোনো সব সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর বহাল। তাতেও আপত্তি অনেকের। কারণ, ৩০ জুনের মধ্যে টাকা তুলতে আসতে পারেননি, শুধু এ কারণে তিনি টাকা কম পাবেন, সরকারের এই আচরণ অযৌক্তিক মনে করেন অনেক গ্রাহক।

জানতে চাইলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শামসুন্নাহার বেগম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করের বিষয়টি একান্তই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার বা বলার নেই।’

পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ছাড়
সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের পেনশনার সঞ্চয়পত্রে কিছুটা কর ছাড় দিয়েছে সরকার। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরাই এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।

এ মাসের শুরুর দিকে প্রথমে এনবিআর, পরে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ থাকলে উৎসে কর দিতে হবে না। বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকার বেশি থাকলেই উৎসে কর ১০ শতাংশ।

এখানেও পুরো ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়নি। সঞ্চয় অধিদপ্তরের ডিজি শামসুন্নাহার বেগম স্পষ্ট করার অংশ হিসেবে বলেন, ‘পাঁচ লাখ টাকার কম পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনা গ্রাহকদের কোনো উৎসে কর দিতে হবে না।’

কারও ২০ লাখ টাকার পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনা থাকলে ৫ লাখ টাকা বাদ দিয়ে তাঁকে বাকি ১৫ লাখ টাকার সুদের ওপর উৎসে কর দিতে হবে কি না, জানতে চাইলে শামসুন্নাহার বলেন, ‘না। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেই কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারেই।’

অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো সংস্কারমূলক কাজ করতে গেলে বাস্তবায়নের জন্য সময় দিতে হয়। পুরোনোগুলো নিয়ে আমরা কিছু করিনি। যাঁরা যা কিনেছেন, কিনেছেন। এখন নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ব্যাংক হিসাব ও কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) লাগবে এবং পাঁচ বছর পর পুরো খাতের সবকিছু তথ্যভান্ডারে চলে আসবে।’

গ্রাহক কারা সরকার জানে না
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সরকারকে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ দিতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যে সুদের বড় অংশেরই সুবিধাভোগী অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা। এমনকি বেশ কয়েকজন সাংসদ যে সঞ্চয়পত্রে বিপুল অর্থ খাটিয়েছেন, এ তথ্য গত সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামাতেই রয়েছে। অথচ জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা, স্বল্প আয়ের মানুষ, সামরিক ও বেসামরিক অবসরভোগী, নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, প্রবাসী বাংলাদেশি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনাই হচ্ছে সঞ্চয়পত্র চালুর উদ্দেশ্য।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, শুধু উত্তোলন করতে না পারার কারণে ১ জুলাইয়ের আগের সুদের টাকার ওপরও যে ১০ শতাংশ উৎসে কর নেওয়া হচ্ছে, তা অন্যায্য। আর, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের চিহ্নিত করতে সরকার আগ্রহী নয়। কারণ, রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারি বড় পদের কর্মচারীরাও এর বড় সুবিধাভোগী।