করপোরেট করের উল্টো যাত্রা

বাংলাদেশে করপোরেট করহার তুলনামূলক বেশি। করপোরেট করহার বেশি হলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা কঠিন। এ দেশে উদ্যোক্তাদের আয়ের বড় অংশ কর হিসেবে দিতে হয়। তবে মধ্যম আয়ের দেশগুলো গত তিন দশকে যে হারে করপোরেট কর কমিয়েছে, বাংলাদেশ সেই তুলনায় তা কমাতে পারেনি।
করপোরেট কর কমালে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হয়। কিন্তু এখানে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয় করপোরেট করকে। তাই প্রতিবছর বাজেটের আগে করপোরেট কর কমানোর আলোচনা থাকলেও প্রতিবারই পিছিয়ে যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘করপোরেট ট্যাক্স রেট: হাউ লো উই ক্যান গো’ শিরোনামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন দশকে মধ্যম আয়ের দেশগুলো গড় করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অন্যদিকে মধ্যম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশ গত দেড় দশকে করপোরেট কর কমিয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ।

সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে করপোরেট কর কমানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গত দেড় দশকে মাত্র একবার করপোরেট করে বড় পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ কর কমানো হয়। এখন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ২৫ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হলে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হয়। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাড়ে ৪২ শতাংশ; মুঠোফোন ও সিগারেট কোম্পানির জন্য ৪৫ শতাংশ এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা আছে। তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের করহার ১২ শতাংশ।
কেন করপোরেট কর কমানো হয় না, এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেট কর কমানোর যুক্তি আছে। কিন্তু করপোরেট কর কমানো হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি হতে পারে। এই ভয় থেকে করপোরেট কর কমায় না এনবিআর।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে তুলনা করতে সাধারণত ওই সব দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট হারের সঙ্গেই সাধারণত তুলনা করা হয়। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খুব বেশি নেই। মাত্র ৩৫৬টি কোম্পানি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত আছে। তাই কোম্পানি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ে নিবন্ধিত দেড় লাখ কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ বা এর বেশি করপোরেট কর আরোপিত হয়। গত অর্থবছরে মাত্র ৩০ হাজার কোম্পানি বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়েছে। করপোরেট করহার বেশি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দেয়। এ জন্য এক লাখের বেশি কোম্পানি করের আওতার বাইরে থাকছে।

গত কয়েক বছরে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার বলেছিলেন, বাজেটে করপোরেট কর কমানোর একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকবে। ব্যবসায়ীদেরও করপোরেট কর কমানোর একটি বড় দাবি ছিল। বাস্তবে করপোরেট কর কমালে রাজস্ব আদায়ে বড় প্রভাব পড়বে, এই আশঙ্কা থেকে এর হার কমানো হয়নি। এনবিআরের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত দেড় দশকে আয়কর খাতে করপোরেট করের অংশ বাড়ছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে করপোরেট কর থেকে আয়করের ৪৫ শতাংশ এসেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয়করের ৬০ শতাংশের বেশি এসেছে করপোরেট কর থেকে। আর এক-তৃতীয়াংশ করপোরেট কর আসে মুঠোফোন, ব্যাংক, সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছ থেকে।

আইএমএফের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী করপোরেট করের পরিমাণ উদীয়মান অর্থনীতির ও উন্নত দেশগুলোর মোট করের ১৫ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর করের ১৭ শতাংশ।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি এবং এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাশেম খান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার আগে দুটি বিষয় দেখেন। প্রথমত, করপোরেট করহার কত, এই কর দিয়ে কতটা মুনাফা করতে পারবেন। সুতরাং করপোরেট কর কমালে এ দেশে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়বে। ক্রমান্বয়ে করপোরেট কর কমানোর একটা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালেও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় করপোরেট n করহার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৮ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশ। শুধু মধ্যম আয়ের দেশ নয়, উচ্চ আয়ের দেশগুলো করহার বেশ কমিয়েছে। ১৯৯০ সালে উচ্চ আয়ের দেশের গড় করপোরেট কর ছিল ৩৮ শতাংশ। এখন তা কমে ২২ শতাংশ হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো এই সময়ে করপোরেট করহার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৯ শতাংশ করা হয়েছে।
আইএমএফ বলছে, উচ্চ করপোরেট করহারের কারণে উন্নত দেশের জোট ওসিইডির বাইরের দেশগুলো থেকে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলার কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়।

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় একেক দেশে একেক করপোরেট করহার। পাকিস্তানে করহার ২৫-৩৫ শতাংশ। ভারতে ৩০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২৮ শতাংশ। এমনকি আফগানিস্তানের করপোরেট করহারও বাংলাদেশের চেয়ে কম; ২০ শতাংশ।
সারা বিশ্বে সংযুক্ত আরব আমিরাতে করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি; ৫৫ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের কোম্পানি পর্যায়ে করহার ২০ শতাংশ। এ ছাড়া মিয়ানমার
ও ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১৭ শতাংশ করপোরেট কর বিদ্যমান।