জমার টাকা ফেরত পেতে ভোগান্তিতে আমানতকারী

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

গত ২৮ জুলাই, দুপুর সাড়ে ১২টা। রাজধানীর গুলশানে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে অপেক্ষারত কয়েকজন আমানতকারী। তাঁরা সবাই জমা টাকার খোঁজ নিতে এসেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ টাকা তোলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ঘুরছেন। এঁদের একজন মামুন হোসেন। বলছিলেন, ‘জমা টাকা তোলার জন্য কেন এতবার আসতে হবে? দেখার কি কেউ নেই? আমি কি ঋণ নিতে এসেছি, যে বারবার আসব?’ সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আর এ নিয়ে কথা বলতে চাইলেন না। জানালেন, ‘এতে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও বিলম্ব হতে পারে।’ 

গত ৭ জুলাই দুপুর আড়াইটায় পল্টনের ডিআর টাওয়ারে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে গিয়েও দেখা মিলল কয়েকজন আমানতকারীর। তাঁরা সবাই টাকা তোলার জন্য ভিড় করেন সেখানে। কেউ কেউ টাকা ফেরত পাচ্ছেন, তবে বেশির ভাগই পাচ্ছেন না। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ২০১৫ সালে হঠাৎ পরিবর্তন হয়েছে। 

একই অবস্থা দেখা গেল বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডেও। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এদিকে পিপলস লিজিং টাকা ফেরত দিতে না পারায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে বিলুপ্ত করতে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো গ্রাহক, প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক টাকা তুলতে না পেরে অভিযোগ দায়ের করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে চাইলে এসব প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটের তথ্য তুলে ধরেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র কোনো সুরাহাই দিতে পারছে না। 

তবে গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কল মানি বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ বাড়িয়েছেবাংলাদেশ ব্যাংক। আবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী যেসব খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছেন, তাতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, বিআইএফসি ও প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের নাম এসেছে। 

কার কী অবস্থা 

জানা গেছে, এফএএস ফাইন্যান্স গ্রাহক ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৮৩৬ কোটি টাকা আমানত নিয়েছে। আবার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৭০০ কোটি টাকা ধার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ দিয়েছে ১ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। আস্থার সংকটে পড়ে আটকে গেছে আমানত সংগ্রহ, ঋণের টাকাও ফেরত আসছে না। 

এফএএস ফাইন্যান্সে ৩৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আটকে গেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকও। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এখনই টাকা না তোলার জন্য বলা হয়েছে। এ জন্য আমরা টাকা তুলতে চাপ দিচ্ছি না। এফএএস ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রীতিশ কুমার সরকার বলেন, ‘গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে বড় গ্রাহকদের টাকা দিতে সমস্যা হচ্ছে। যেসব ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, তা পুনঃ তফসিলের চেষ্টা চলছে।’ 

 ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করে ঋণ দিয়েছে। গত ডিসেম্বরের হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির ৫ শতাংশ ঋণখেলাপি ছিল। তবে নতুন আমানত না আসায় সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা সৈয়দ আবেদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি উন্নয়নে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

প্রিমিয়ার লিজিং ছোট গ্রাহকদের টাকা দিলেও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটির এমডি আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, মানুষ টাকা জমা দিতে চাইছেন না। আমরা ছোট গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছি। যেসব বড় গ্রাহক রয়েছেন, তাঁদের কিস্তি আকারে টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। 

৩২ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় ফার্স্ট ফিন্যান্সও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে এ খাতে ভালো কিছু প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। 

গত বুধবার মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না, তাঁরা কার কাছে যাবেন? জবাবে ডেপুটি গভর্নর এস এম মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘আইনে যা বলা আছে, সেভাবে চলবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আরও প্রতিষ্ঠান অবসায়ন হবে, এমন আশা করা ঠিক হবে না। কিছু কিছু ভালো-মন্দ ঘটতেই পারে।’ আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই।

ঋণ নেওয়ার সুযোগ বাড়ল

এক প্রজ্ঞাপনে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কল মানি বাজার থেকে ২০১৮ ভিত্তিক মূলধনের (ইক্যুইটি) সর্বোচ্চ
৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে। আগে নিতে পারত ৩০ শতাংশ।