ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগ করে বিপাকে অনেক ব্যবসায়ী

কয়েক বছর আগেও আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। দ্রুত সরকারি অনুমোদন পেতে ব্যবসায়ীরা তোড়জোড়ও শুরু করেছিলেন। সেই ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়ে আছেন অনেক বিনিয়োগকারী।

ইথিওপিয়া নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদনও তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বশেষ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। দেশটির রাজধানীর আদ্দিস আবাবা থেকে ২৭৩ কিলোমিটার দূরের হুওয়াসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাকের ব্যবসায় বড় খেলোয়াড় হতে হলে মজুরি, জাতিগত দ্বন্দ্বের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

মূলত, চীন ও বাংলাদেশের মডেল অনুসরণ করে পোশাক রপ্তানির ব্যবসা বড় আকারে ধরতে চায় ইথিওপিয়া। অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করে সেখানে অবিশ্বাস্য কম মজুরি, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি আর কম দামে জ্বালানি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে পূর্ব আফ্রিকার এই দেশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে কিছুটা এগিয়েছে ইথিওপিয়া। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম, জেসি পেনি, চিলড্রেন প্যালেস, ক্লেভিন ক্লেইন, টমি হিলফিগারের পোশাক তৈরি হচ্ছে দেশটির পোশাক কারখানায়। বছরে ১৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করছে তারা। ২০২৫ সালের মধ্যে সেই রপ্তানি তিন হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চায় দেশটির সরকার। সে জন্য বিনিয়োগ আনতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা পাঁচ থেকে ত্রিশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে তারা।

প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি সম্ভাবনার সঙ্গে ইথিওপিয়ায় আছে অনেক সমস্যা। পোশাকশ্রমিকের মাসিক মজুরি মাত্র ২৬ ডলার। তাতে শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদাও মিটছে না। কম মজুরির কারণে পোশাক উৎপাদনের খরচ কম হওয়ার কথা। উল্টো বেশি হচ্ছে। কারণ, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে কম। আবার প্রায়শই শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কারখানা বন্ধ থাকছে। অসন্তোষের জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে স্থানীয় রাজনীতিকেরাও ইন্ধন দিচ্ছেন। আছে জাতিগত দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় একটি টি-শার্ট উৎপাদনের খরচ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে। সে জন্য সেখানে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারা আছে বিপদে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের ডিবিএলও আছে।

চীন ও বাংলাদেশ মডেল

আশির দশকের শুরুতে পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধি করে চীন। বর্তমানে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ এই দেশ বেসিক টি-শার্ট ও ট্রাউজারের মতো পোশাকের পরিবর্তে বেশি দামের পণ্য তৈরিতে ঝুঁকছে। বছরে চীনা শ্রমিকদের মজুরি ১০ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মজুরি বেড়ে যাওয়ায় অনেক ক্রেতাই কম দামে পোশাক উৎপাদনের জন্য বিকল্প দেশ খুঁজছে।

>পোশাক রপ্তানির ব্যবসা বড় আকারে ধরতে চায় ইথিওপিয়া
ব্যবসা ধরতে চীন-বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ ইথিওপিয়ার
নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে দেশটি
ব্যবসায় সম্ভাবনার সঙ্গে ইথিওপিয়ায় আছে অনেক সমস্যা


অন্যদিকে কাঁচামাল না থাকলেও শুধু কাটিং ও সুইংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

চীনসহ অন্যান্য দেশের শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমা ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন জায়গা খুঁজছে। নিজেদের দেশে শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় পোশাক রপ্তানিতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছে ইথিওপিয়া। ব্যবসাটি ধরতে চীনকে অনুসরণ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে তারা।

বাংলাদেশের মতো ইথিওপিয়ায় কাঁচামালের জোগান নেই। আমদানিই মূল ভরসা। তাই বাংলাদেশকে অনুসরণ করে পোশাক রপ্তানির ব্যবসায় এগিয়ে যেতে চায় ইথিওপিয়া। একটি জায়গায় অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে ইথিওপিয়া এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে শ্রমিকের মাসিক নিম্নতম মজুরি ৯৫ ডলার। ইথিওপিয়ায় মাত্র ২৬ ডলার।

সমস্যার পর সমস্যা

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চীনা অর্থায়নে রাস্তাঘাট ও বিমানবন্দর নির্মাণ করছে ইথিওপিয়া সরকার। পণ্য পরিবহনের জন্য ৩২০ কোটি ডলার ব্যয়ে স্থলবেষ্টিত দেশটির রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের সমুদ্রবন্দর দিজবুতি পর্যন্ত ৭৫৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করছে।

দেশটির ২৩ শতাংশ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। উন্নত জীবনযাপনের আশা নিয়ে পোশাক কারখানায় আসা শ্রমিকেরা শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছেন। কারণ, মাসিক ২৬ ডলার বা ২ হাজার ২১০ টাকা মজুরি দিয়ে তাঁদের ন্যূনতম চাহিদা মিটছে না। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। নতুন নতুন কারখানার কারণে হুওয়াসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের আশপাশের এলাকার এক কক্ষের বাসার মাসিক ভাড়া ১৪-১৫ ডলার থেকে বেড়ে ৫২ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। দেশটির মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ৭৮৩ ডলার হলেও পোশাক শ্রমিকেরা পাচ্ছেন মাত্র তার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।

গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান ২৫ কোটি ডলার ব্যয়ে পার্কটি নির্মাণ করেছে। সেখানে কারখানা করে ২০১৭ সালে আমেরিকান ব্র্যান্ড পিভিএইচ প্রথম শার্ট রপ্তানি করে। তবে তারা শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তাদের কারখানায় কর্মদক্ষতা ছিল মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ। সে জন্য না লাভ, না লোকসান, সেই অবস্থায় যেতে পারেনি তারা।

ইথিওপিয়ায় গত বছরের এপ্রিলে আবি আহমেদ দেশটির ক্ষমতায় আসেন। আশপাশের দেশের সঙ্গে শান্তি ফেরাতে তিনি হাজারখানেক রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেন। অথচ স্থানীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তেজিত করে। সে কারণে শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। কারখানার উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ডিবিএলের অভিজ্ঞতা

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার পাশের শহর মেকেলেতে গত অক্টোবরে নিজেদের কারখানার উৎপাদন সীমিত আকারে শুরু করেছে বাংলাদেশের দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল গ্রুপ। সেখানে কাজ করছেন আড়াই হাজার শ্রমিক।

ডিবিএলের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইথিওপিয়ায় যারা বিনিয়োগ করেছে, সবাই বিপদে আছে। সেখানে অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ কিছুই নেই। ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বন্দর নেই। আছে রাজনৈতিক সমস্যা। পোশাক রপ্তানিতে দেশটির অনেক সম্ভাবনার কথা বলা হলেও আসলে কিছুই হবে না। আমরা ইতিমধ্যে সেখানকার কারখানার সম্প্রসারণ স্থগিত করেছি।’