অর্ধেকের বেশি চামড়া নষ্ট হবে এবার

সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। সংকুচিত হয়ে পড়েছে সড়ক। এতে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো। ছবি: জুয়েল শীল
সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। সংকুচিত হয়ে পড়েছে সড়ক। এতে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো। ছবি: জুয়েল শীল

কাঁচা চামড়ার দামে বড় ধসের কারণে এবার কোরবানির পশুর চামড়ার অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে যাবে। নষ্ট হওয়া চামড়ার আর্থিক মূল্য কমপক্ষে ২৪২ কোটি টাকা। অবশ্য চামড়া রপ্তানির হিসাব করলে ক্ষতির অঙ্কটি হবে কয়েক গুণ বেশি।

গত দুই দিনে ট্যানারিমালিক ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোরবানির ঈদে সারা দেশ থেকে ৫৫-৬০ লাখ গরু এবং ৩৫-৪০ লাখ মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাঁদের। তবে ন্যূনতম দাম না পেয়ে কমপক্ষে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার সময়মতো লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও কমপক্ষে ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হবে। অন্যদিকে দামের ধসের কারণে নষ্ট হয়েছে ছাগল ও ভেড়ার ৮০ শতাংশ চামড়া। তার মানে প্রায় ১ কোটি চামড়ার মধ্যে ৫৩ লাখ চামড়াই নষ্ট হবে। 

সরকার–নির্ধারিত হার অনুযায়ী, এবার ৩০ থেকে ৩৫ বর্গফুটের বড় আকারের গরুর চামড়ার দাম হওয়ার কথা দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। আর ১৫ থেকে ২৫ বর্গফুটের ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। একেকটি গরুর চামড়ার দামে গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলে ২১০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। আর একেকটি ছাগলের চামড়া ১০০ টাকা ধরলে ক্ষতি ৩২ কোটি টাকা। ট্যানারির মালিক ও আড়তদারেরা বলছেন, প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হবে। চামড়াগুলো ঠিকঠাক থাকলে বিভিন্ন পর্যায়ে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হতো। 

কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনায় সরকারের কার্যকর নজরদারি ও উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। অভিযোগ আছে, এই সুযোগে এবার আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের কারসাজিতে চামড়ার দামে ধস নেমেছে। ঈদের দিন বিকেলে ঢাকায় ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি হয়। আবার পরদিন পোস্তার চামড়ার আড়তে বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। তাতে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম পড়ে ৩ থেকে ২০ টাকার মতো। অথচ সরকারি দর ছিল প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫-৫০ টাকা। তবে সারা দেশের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। দাম না পেয়ে লোকসান গুনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীতে চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি আড়তেই কমবেশি লবণযুক্ত চামড়া মজুত আছে। ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কেনা শুরু না করায় আড়তদারেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

আড়তদার মো. এবায়েতউল্লাহ, মো. আশরাফ, মো. হাফিজসহ কয়েকজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি আড়তদার বলেন, চামড়ার দামের ধস হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮৯ সালে ওয়েট ব্লু চামড়া (রাসায়নিক দিয়ে চামড়াকে পশম ও ঝিল্লিমুক্ত করা) রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর থেকেই আড়তদারেরা ট্যানারির মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। পাইকার ও আড়তদারের প্রচুর অর্থ তাঁদের কাছে আটকে আছে। ট্যানারির মালিকেরা হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরে নেওয়া এবং রপ্তানি কমে যাওয়ার অজুহাতে ঈদের আগে পাওনা টাকা ১-৫ শতাংশের বেশি দেননি। বকেয়া টাকা শিগগিরই পাওয়ার আশাও কম। অনিশ্চয়তার কারণে নিজের গাঁটের টাকা বিনিয়োগ করেননি অধিকাংশ আড়তদার। তাই চামড়ার দাম ব্যাপকভাবে পড়ে গেছে। তবে দু-তিন বছর ধরেই অবস্থা বেশি খারাপ। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিত, তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো যেত বলে মনে করেন তাঁরা। 

জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ বাণিজ্যসচিব মো. মফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চামড়া নষ্ট হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। ঈদের আগে আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে দাম নির্ধারণ করেছিলাম। তবে সেই দরে চামড়া বেচাকেনা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শনিবার থেকে ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কেনা শুরু করবেন। তখন অবস্থার উন্নতি না হলে আমরা প্রথমে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেব।’   

ঈদের আগে মাঠপর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা না বুঝেই দাম নির্ধারণ করায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দুষলেন আড়তদারদের সমিতি বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আলী হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি দাম নির্ধারণ করার জন্যই বিপর্যয়। ৫০ শতাংশের বেশি চামড়া নষ্ট হবে। আর বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাবেক সভাপতি আবু তাহের মনে করেন, চামড়ার দর বেঁধে না দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দামে কেনার ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি ততটা খারাপ হতো না।  

সরকারের নজরদারির অভাব, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিরাট ফারাক, চামড়া আমদানিসহ কয়েকটি কারণে চামড়ার দামে ধস নেমেছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সীমিত পরিসরে ওয়েট ব্লু আকারে চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিতে পারে সরকার। তবে এর আগে চামড়া পণ্য ও জুতা উৎপাদনকারী কারখানার চাহিদার বিপরীতে কাঁচা চামড়ার জোগান হিসাব করতে হবে। সেটি হলে চামড়া নিয়ে ভবিষ্যতে বিপর্যয় কিছুটা হলেও ঠেকানো যাবে।