ক্রিসেন্টে আটকে গেছে চামড়ার ঋণ ছাড়

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

চামড়া ব্যবসায়ী ক্রিসেন্ট গ্রুপের জন্য এমনিতেই বিপদে জনতা ব্যাংক। ক্রিসেন্টের জালিয়াতির কারণেই চামড়া খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো এবার ছিল অতি সতর্ক। আর এতেই আর্থিক সংকটে পড়েছে পুরো চামড়া খাত।

এবার চামড়া কিনতে ব্যাংকগুলো ঠিকই ঋণ অনুমোদন করে, তবে বকেয়া শোধ না করায় সেই ঋণের টাকা তুলতে পারেননি ট্যানারিমালিকেরা। এর ফলে কোরবানির চামড়া কিনতে আড়তদারদের হাতে টাকা পৌঁছায়নি। ঈদের মৌসুমে চামড়া কিনতে গত রোববার পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংক। রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকসূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও অনেক ট্যানারিমালিক ঋণের জন্য আবেদন করেন। তবে জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের জালিয়াতির কারণে সবাই ঋণ বিতরণে ছিল সতর্ক। ফলে যাঁদের কোনো বকেয়া ছিল না, কেবল তাঁরাই ঋণের অর্থ তুলতে পেরেছেন।

জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্টের জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফখরুল আলম ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদের এখন জেলে। পলাতক রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ। তিনি এম এ কাদেরের ভাই। তবে পলাতক অবস্থাতেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে চলছে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সিনেমা মাসুদ রানা নির্মাণের কাজ।

চামড়ায় ঋণছাড় অল্পই

 জানা গেছে, সরকারি চার ব্যাংক মিলে চামড়া খাতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনেক ব্যাংক পুরোনো ঋণ নবায়নকেই ঋণ হিসেবে গণ্য করছে। আবার অনেকে ঋণ তোলার সক্ষমতা নেই, এমন গ্রাহকের অনুকূলেও ঋণ অনুমোদন করেও অর্থ ছাড় করতে পারেনি।

যেমন সোনালী ব্যাংক এবার তিনটি ট্যানারির জন্য ৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। এর মধ্যে ভুলুয়া ট্যানারির জন্য ২৫ কোটি, কালাম ট্যানারির ২০ কোটি ও আমিন ট্যানারির জন্য ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করায় কেবল সাড়ে ৭ কোটি টাকা তুলতে পেরেছে ভুলুয়া ট্যানারি।

ব্যাংকগুলোর নিয়ম অনুযায়ী, চামড়া ব্যবসায়ীদের যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়, চামড়া কিনতে তার ৩০ শতাংশ টাকা তুলতে পারে। আর চামড়া আধা প্রক্রিয়াজাত বা ওয়েট ব্লু করার জন্য দেওয়া হয় ৩০ শতাংশ। এরপর বাকি কাজ শেষ করতে তুলতে পারে ৪০ শতাংশ টাকা। চামড়ার ঋণ শোধ করতে হয় ২৭০ দিন বা ৯ মাসের মধ্যে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, চামড়াঋণে যে আবেদন এসেছিল, তা যাচাই–বাছাই করে ৭০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়। গ্রাহকের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে, তারা ঋণ তুলতে পারবে কি না। 

অগ্রণী ব্যাংক দেড় শ কোটি টাকা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে অ্যাপেক্স ট্যানারি তুলতে পেরেছে ২০ কোটি টাকা, ঢাকা হাইডস ৩০ কোটি টাকা ও দোয়েল ইন্টারন্যাশনাল পেয়েছে ১ কোটি টাকা। ফলে অগ্রণী ব্যাংক দিয়েছে ৫১ কোটি টাকা। 

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে ঋণ অনুমোদন করেছিলাম, গ্রাহকদের সবাই সেই ঋণ তুলতে পারেনি। যদিও অনেক ছাড় দিয়েই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল।’

জনতা ব্যাংক দেড় শ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বললেও ব্যাংকটির স্থানীয় ও জনতা ভবন শাখা থেকে গতকাল পর্যন্ত কোনো ঋণ বিতরণ হয়নি। একই অবস্থা রূপালী ব্যাংকের। ১৫৫ কোটি টাকা অনুমোদন দিলেও কেউ টাকা তুলতে পারেনি। গ্রাহকদের মধ্যে সামিনা ট্যানারির জন্য ৫৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হলেও তাদের আগের বকেয়া রয়েছে ৬৪ কোটি টাকা, ১৫ কোটি টাকা অনুমোদনের বিপরীতে এইচএনএইচ ট্যানারির বকেয়া সাড়ে ১২ কোটি টাকা এবং বেঙ্গল লেদারের ৮৫ কোটি অনুমোদনের বিপরীতে বকেয়া ৮৩ কোটি টাকা।

২০১৮ সালে চামড়া খাতে জনতা ব্যাংক ২০৫ কোটি, রূপালী ১৫০ কোটি, অগ্রণী ১০০ কোটি ও সোনালী ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংক ছোট আকারের ঋণ বিতরণ করে। 

ক্রিসেন্ট–কাহিনি

ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে পাওনা ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা আদায়ে তাদের সম্পদ নিলাম ডেকেও টাকা আদায় করতে পারেনি জনতা ব্যাংক। নিলামকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাড়ে ১৬ শতাংশ প্লট, সাভার ও হাজারীবাগের জমি, যন্ত্রপাতিসহ কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।

গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের খেলাপি ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টসের ৮৬৪ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজের ১৭০ কেটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪৩০ কোটি টাকা ও রূপালী কম্পোজিট লেদারের ৮৮৮ কোটি টাকা। 

রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও বড় শহরে ছিল ক্রিসেন্ট গ্রুপের চামড়াজাত পাদুকাপণ্যের অনেক বিক্রয়কেন্দ্র, যার বেশির ভাগ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বাইরে পণ্য রপ্তানি করলেও প্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ফেরত আনেনি গ্রুপটি। অথচ এর বিপরীতে সরকার থেকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা নগদ রপ্তানি প্রণোদনা নিয়েছে গ্রুপটি। 

রপ্তানি না করেও ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০ জনের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারিতে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরও। মালিকদের মধ্যে সাতজনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। অন্যতম আসামি রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিটুন জাহান। ব্যাংকারদের মধ্যে আসামি ১৫ জন।