প্রকল্প পরিচালক চামড়াশিল্পকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়েছেন

চামড়ার দামে ধস। সেই চামড়া ট্যানারি পর্যায়ে বেচাবিক্রি নিয়েও তৈরি হয় সংকট। চামড়াশিল্প নগর নিয়েও আছে জটিলতা। এসব নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে অরাজকতা কেন?

মহিউদ্দিন আহমেদ
মহিউদ্দিন আহমেদ

মহিউদ্দিন আহমেদ: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভা করে আমরা চামড়ার একটি দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। সেটি বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি ছিল। গত তিন মাসে কী পরিমাণ চামড়া কী দামে রপ্তানি হয়েছে, তার গড় বের করলে বাজারমূল্য পাওয়া যেত। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেদিকে না গিয়ে এতিম ও মাদ্রাসার কথা চিন্তা করে দামটা বেশি দিয়েছে। সেটি আমরা মেনে নিয়েছি। কারণ, অনেক সমস্যার মধ্যে থাকলেও আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে কোরবানির চামড়ার দামে ধসের সঙ্গে কোনোভাবেই ট্যানারিমালিকেরা জড়িত নন। বর্তমানে দেশে ট্যানারি আছে ১৫০-১৫৫টি। ট্যানারিমালিকদের পক্ষে ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা চামড়া কিনি কমপক্ষে চারটি হাত বদল হওয়ার পর। সরকারনির্ধারিত দামেই তো চামড়া কিনছি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—কেন চামড়ার দামে ধস নামল? কারা জড়িত? ধসের সঙ্গে কারা জড়িত, কেন জড়িত, সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

প্রথম আলো: আপনারা ব্যবসায়ীরা কি দায় এড়াতে পারেন?

মহিউদ্দিন আহমেদ: দেশের নাগরিক হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতা এড়াতে পারি না। তবে আমাদের ব্যবসায়ী হিসেবে দায়বদ্ধতা নেই। কারণ, কাঁচা চামড়া কেনাবেচায় আমাদের অংশ নেওয়ার কিছু ছিল না।  যারা প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যবসা করে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের সম্পৃক্ততা আড়তদারদের সঙ্গে আছে। আমি বলতে চাচ্ছি, যেহেতু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনছেন, তাই লবণ দেওয়ার ব্যবস্থাও তাঁদের করতে হবে। এক দিনে যদি ৫০ হাজার টাকা আয় করতে চান, সেটি লটারি হয়ে যাবে। এটি লটারি না, তাঁদের জন্যও ব্যবসা হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: আড়তদারেরা বারবার অভিযোগ করছেন, ট্যানারিমালিকেরা তাঁদের পাওনা না দেওয়ার কারণে মাঠপর্যায়ে চামড়ার দামে ধস নামে। তারপরও আপনি বলছেন, আপনাদের কোনো দায় নেই?

মহিউদ্দিন আহমেদ: আমাদের সমিতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য নেই, কোন ট্যানারির কাছে কোন আড়তদার কত টাকা পাবে? ঢালাওভাবে যে বকেয়া আছে, সেটি আমাদের জানা নেই। এভাবে যে সংকট তৈরি হবে, সে রকম তথ্য নিয়ে আড়তদারেরা আমাদের কাছে আসেননি। তাহলে আমরা কীভাবে জানব? ঘটনা ঘটার পর আড়তদারেরা ঢালাওভাবে অভিযোগ করছেন। তাঁরা আগে কেন বলেননি?

প্রথম আলো: তাহলে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্টের পেছনে দায় কার?

মহিউদ্দিন আহমেদ: ঈদের আগে আমরা বলেছি, ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ লাগাতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী সময়মতো লবণ লাগাননি, তাঁরাই চামড়া নষ্টের জন্য শতভাগ দায়ী। তাঁরা কাজটি ঠিকঠাক করলে দায়ভার বিভিন্ন জায়গায় দিতে পারতাম।

প্রথম আলো: চামড়া নষ্টের বড় কারণ তো দামের ধস…

মহিউদ্দিন আহমেদ: দাম তো নির্ধারণ করাই ছিল। তা মানলে চামড়ার দাম এত কমার কোনো কারণ নেই। তবু কেন নির্ধারিত দামে বেচাকেনা হলো না, কারা কারসাজি করল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল—এগুলো সরকার খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।

প্রথম আলো: সাভারে চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ পুরো শেষ হয়নি। ট্যানারিমালিকেরা বলছেন, চীনাদের তৈরি সিইটিপি আন্তর্জাতিক মানের হবে না। আপনার কী মত?

মহিউদ্দিন আহমেদ: সরকার সিইটিপি করে দিচ্ছে। এটিকে সচল করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা আমরা খুঁজে বের করেছি। সে অনুযায়ী কাজ হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে যে চেষ্টা করছে, আগে সেটি করেনি। গত ১০ বছরে চামড়াশিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ৭-৮ বার বদলেছে। বিসিকের চেয়ারম্যান বদলেছে বেশ কয়েকবার। তাহলে সরকারিভাবে দায়িত্বটি কার ঘাড়ে বর্তাবে। উল্টো একজন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, যিনি অর্বাচীনের মতো কথা বলে চামড়াশিল্পকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন।

প্রথম আলো: সেটি কীভাবে?

মহিউদ্দিন আহমেদ: সেই পিডি বলেছিলেন, চামড়াশিল্প নগর পুরোপুরি প্রস্তুত, তবে ট্যানারিমালিকদের অনীহা আছে। তাঁর মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের জোর করে সাভারে পাঠাতে হাজারীবাগে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তখন শতকোটি টাকার চামড়া প্রক্রিয়াজাতের মধ্যে ছিল, সবই নষ্ট হয়ে গেল। আমরা ক্রেতা হারালাম, অর্থসংকটে পড়লাম।

প্রথম আলো: ট্যানারিমালিকেরা বলছেন, শিল্পনগরের জমির ইজারা দলিল না পাওয়ার কারণে তাঁরা অর্থসংকটে ভুগছেন। কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন না। দাম নির্ধারিত হওয়ার পরও কেন ইজারা দলিল বুঝে পাচ্ছে না ট্যানারিগুলো?

মহিউদ্দিন আহমেদ: জমির দাম ঠিক হয়েছে। এখন বিসিক হয়তো চিঠি ইস্যু করবে। তারপর আমরা আমাদের সদস্যদের ইজারা দলিলের জন্য জানাব। তবে হয়তো কেউ কেউ মানে সবাই জমির মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। অনেকেই আর্থিক সংকটের মধ্যে আছেন।  ট্যানারিমালিকেরা তো বর্তমানে আইসিইউতে আছেন। হাজারীবাগের জমি রাজউক রেড জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। হয় জায়গা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক, কিংবা সরকার বর্তমান বাজারমূল্যে জমি অধিগ্রহণ করে নিতে পারে।