চামড়ার মান খুবই ভালো কাজে লাগানো যাচ্ছে না

চামড়াশিল্প নগরে যারা বেশি জমি পেয়েছে, তাদের একটি বে ট্যানারি। তবে কারখানা নির্মাণ করেও উৎপাদন বন্ধ রেখেছে তারা। কারখানা বন্ধ রাখার কারণ এবং চামড়াশিল্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বে গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ

প্রথম আলো: চামড়াশিল্পের পরিস্থিতি কী? আমরা দেখছি রপ্তানি কমছে, চামড়ার দামেও ধস।

শামসুর রহমান
শামসুর রহমান

শামসুর রহমান: চামড়া দেশের খুব সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে সরকার চামড়াশিল্প নগর প্রতিষ্ঠা করেছে। ট্যানারিগুলোকে সরিয়ে সাভারে নিয়েছে। এই কঠিন কাজটি সম্ভব হলেও চামড়াশিল্পের সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ, শিল্পটি এখনো পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না পেলে বিদেশি বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়া কিনবে না। এলডব্লিউজির সনদ পেতে হলে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব হতে হবে।

প্রথম আলো: দেশের চামড়া খাত সম্ভাবনাময়, অনেক দিন ধরে এটা শুনছি। কিন্তু কার্যকারিতা তো দেখছি না। তাহলে এ খাত সম্ভাবনাময় বলা হচ্ছে কেন?

শামসুর রহমান: এ দেশের গরুর চামড়ার রোমকূপের ছিদ্রগুলো খুব ছোট হয়। এটা জুতা তৈরির জন্য খুবই ভালো। এই মানের কিছু চামড়া পাওয়া যায় ইউরোপে। সেখানে বাচ্চা কিছু গরু জবাই করা হয়। ওই চামড়া ভালো। তবে জোগান খুবই কম। এ দেশে খামারিরা গরুকে নিয়মিত গোসল করান, যত্ন নেন। পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া গরুর চামড়ার মান আরও ভালো হয়। চামড়ার মানের কারণে এ খাতকে সম্ভাবনাময় বলা হয়। 

প্রথম আলো: কিন্তু এত ভালো চামড়ার দাম কেন পাওয়া গেল না এবার?

শামসুর রহমান: দেখেন, দেশের চামড়া এত ভালো। কিন্তু আমরা সেটা ব্যবহার করতে পারছি না। বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশি চামড়া কেনে না। যদি কিনত, প্রতি বর্গফুট প্রস্তুতকৃত চামড়ার দাম আমরা আড়াই ডলার পেতাম। এখন সেটা এক ডলার বা তার সামান্য কিছু বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে।

প্রথম আলো: এবার আপনারা চামড়া কিনেছেন?

শামসুর রহমান: না। গতবারও কিনিনি। হাজারীবাগে থাকতে আমরা কোরবানির এক লাখ চামড়া কিনতাম।

প্রথম আলো: এবার কেন কেনেননি?

শামসুর রহমান: আমরা চামড়াশিল্প নগরে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তাইওয়ানের টেচ্যাং লেদার প্রোডাক্টসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ট্যানারি করেছি। বিশ্বব্যাপী চামড়ার বড় সরবরাহকারীদের একটি টেচ্যাং। তারা বড় একটি ব্র্যান্ডের কাছ থেকে কার্যাদেশ নেয়। ব্র্যান্ডটি নিরীক্ষা করিয়ে দেখে যে চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) কার্যকর নয়। তখন কার্যাদেশ বাতিল করে। টেচ্যাংও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। আমরা এখন ঋণখেলাপি হওয়ার পথে।

প্রথম আলো: আপনারা কয়েকটি ট্যানারি সাভারে আলাদা ইটিপি করতে কেন চাইছেন?

শামসুর রহমান: কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া সময় সাপেক্ষ ও কঠিন বিষয়। সেখানে লবণ পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। এলডব্লিউজির নিরীক্ষকেরা সেটা দেখে গেছে। আমরা ও অ্যাপেক্স ট্যানারি আলাদা ইটিপি করার অনুমতি চেয়েছিলাম। অনুমতি দেওয়া হলে আগামী ঈদের আগেই আমরা ইটিপি করতে পারব। অনুমতি দিলে সরকারেরও লাভ। কারণ, সিইটিপির সক্ষমতা কম। এটি দিনে ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। অথচ মৌসুমে দিনে বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৪০ হাজার ঘনমিটারের মতো। কয়েকটি ট্যানারি আলাদা ইটিপি করলে সরকারকে নতুন বিনিয়োগ করে সিইটিপির সক্ষমতা বাড়াতে হবে না।

প্রথম আলো: বড়রা আলাদা ইটিপি করলে ছোটদের কী হবে?

শামসুর রহমান: আমরা আলাদা ইটিপি করলেও সিইটিপির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বহন করব। কয়েকটি ট্যানারি এলডব্লিউজির সনদ পেলে ছোট ট্যানারিও উপকৃত হবে। দেশে অন্তত ৫০টি জুতা তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে।

প্রথম আলো: এলডব্লিউজির সনদ শুধু ইটিপির ওপর নির্ভর করে না। কারখানার আরও অনেক বিষয় আছে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তুতি কেমন?

শামসুর রহমান: আমরা এলডব্লিউজির সনদ পাওয়ার উপযোগী করেই ট্যানারি করেছি। উদারহণ দিয়ে বলতে পারি, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে পানির ব্যবহার সীমিত রাখতে অনেকগুলো মিটার বসিয়েছি। এলডব্লিউজি মানের বিষয়ে খুব কঠোর। তারা উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়মিত নজরে রাখে। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

প্রথম আলো: অনেকে বলছে, সাভারে বিনিয়োগ করে তাদের পুঁজি শেষ। এ কারণে এবার চামড়া কিনতে অর্থায়ন কম হয়েছে। আসলে কী?

শামসুর রহমান: এ সমস্যা কাটানোর সহজ উপায় হলো সাভারের জমির ইজারা দলিল বুঝিয়ে দেওয়া। এর পাশাপাশি হাজারীবাগের জমির ওপর যে ঋণ নেওয়া আছে, সেটা স্থানান্তর করে সাভারে নেওয়া। এতে হাজারীবাগের জমি বিক্রি করে ট্যানারিমালিকেরা ব্যাংকের ঋণ শোধ ও বিনিয়োগ করতে পারবেন। অনেক ট্যানারির মালিক অসুবিধায় আছেন। এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।