সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়

>
করপোরেট জগতে নিজের নানা গল্প শোনালেন এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের এমডি সৈয়দ আলমগীর। ছবি: এবং বাণিজ্য
করপোরেট জগতে নিজের নানা গল্প শোনালেন এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের এমডি সৈয়দ আলমগীর। ছবি: এবং বাণিজ্য
নতুন একটি সাবান বাজারের সুপরিচিত সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে গেল শুধু একটি স্লোগানের জোরে। স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’, যা এসেছিল সৈয়দ আলমগীরের মাথা থেকে। এবং বাণিজ্যকে নিজের জীবনের কথা জানিয়েছেন এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর, উঠে এসেছে তরুণদের প্রতি তাঁর পরামর্শও। কথা বলেছেন রাজীব আহমেদ

জীবনের মোড় ঘুরিয়েছে যে সিদ্ধান্ত 

আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্তটি। সেখানে পড়েছি বলেই আমি এই পথে এসেছি। আইবিএ থেকে এমবিএ করার পরই আমার অনেকগুলো চাকরির প্রস্তাব আসে। আমরা ৩৩ জন বের হয়েছিলাম। আমি যোগ দিলাম এমন একটি জায়গায়, যেখানে শুধু একজন নেবে। বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা আমি চাইনি। আমাদের বড় একটা ফার্মেসি ছিল। বড় ভাই চিকিৎসক। এ কারণে ওষুধের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। এ কারণে মে অ্যান্ড বেকারে (এখনকার সানোফি) যোগ দিই। 

সেখানে ১৬ বছর ছিলাম। এ সময় আমি অনেক কিছু শিখেছি। একটা উদাহরণ দিই, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি শিখিয়েছে মে অ্যান্ড বেকার। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও কোম্পানি শিখিয়ে দিত। মে অ্যান্ড বেকারে আমি ব্যাপক শৃঙ্খলা শিখেছি।

জীবনের সেরা তিন সিদ্ধান্ত

এক. সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে বেসরকারি খাতে আসা। দুই. যমুনায় যোগ দেওয়া। তিন. এসিআইতে আসা। যমুনায় যোগ দিয়ে আমি বৃহত্তর পরিসর পেয়েছি। আগেরটি ছিল শুধু ওষুধ। যমুনায় শুরুতেই আমি ১১টি কোম্পানি আমার অধীনে পাই। আমি সেগুলোকে বড় করেছি। আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও এক শ ভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইতে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এটির কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি।

 ব্র্যান্ড তৈরির পেছনের গল্প

জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে আমি দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এল, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। সেই চিন্তাটি দেশে এসে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, ‘মেধা বিকাশে সহায়তা করে’। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি। 

 সারা দিনের রুটিন

কাজ দিয়েই আমার দিন শুরু হয়। কাজ দিয়েই শেষ। কাজের বাইরে তেমন কিছু করতে পারি না। সকালে অফিসে আসি ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। ফিরি রাতে। কখনো ৯টার আগে নয়। ফেরার সময় একটি হোটেলে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটি অথবা ব্যায়াম করি। পরিবারের সঙ্গে বাকি সময় কাটাই। তবে অফিসের আলাপ কখনোই বাসায় করি না। আমার স্ত্রীকে যদি আমার অফিস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, তিনি এটুকুই বলতে পারবেন যে সম্প্রতি আমি মনে হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছি।

 কাজের বাইরে

দেশ ঘুরতে আমার ভালো লাগে। এ জন্য প্রচুর ভ্রমণ করি। টেলিভিশন দেখতে ভালো লাগে। রাতে দেশি–বিদেশি সংবাদ চ্যানেল দেখে নিজেকে আপডেট রাখার চেষ্টা করি। বিনোদনের জন্য সিরিয়াল, সিনেমা দেখি। একবার ভারতে গিয়ে সিনেমা দেখতে যাব। মেয়েরা দেখবে গুরুগম্ভীর সিনেমা। আমি বললাম, গোবিন্দর সিনেমা দেখব। পয়সা খরচ করে কান্নাকাটি করতে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আর সিনেমা দেখা হলো না। আমার তিন মেয়ে—একজন চিকিৎসক, একজন আইন পড়ছে এবং আরেকজন অর্থনীতিবিদ। তারা বিদেশে আছে।

 কী হতে চেয়েছিলেন

লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পেয়েছি। লক্ষ্য ছিল, আমি যেখানে কাজ করব, সেখানকার নেতা হব। সেটা হতে পেরেছি। কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বাসী নই। সারা দিন হয়তো আমি নানা কথা বলি। আমার কর্মীরা তাতে মোটেও কষ্ট পায় না। কারণ, তারা জানে, আমি তাদের কতটা ভালোবাসি। 

 ব্যবস্থাপকদের দক্ষতা 

আমাদের দেশের ব্যবস্থাপকেরা কিন্তু অনেকের চেয়ে ভালো। এ দেশের কোম্পানি এ দেশের ছেলে–মেয়েরাই চালাচ্ছে। হয়তো দু–একজন বিদেশি থাকে। তবে বিদেশি কোম্পানির প্রবণতা হলো, তারা একজন বিদেশিকে পাঠিয়ে দিতে পছন্দ করে। 

 তরুণদের জন্য তিন পরামর্শ 

মূল পরামর্শ একটাই—তরুণেরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, চাকরিজীবনে একটি সিঁড়ির পর আরেকটি সিঁড়িতে পা দিয়ে তবে ওপরে উঠতে হয়। এখানে এমন কোনো সিঁড়ি নেই, এলিভেটর নেই, যা আপনাকে সরাসরি ওপরে নিয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাঙ্ক্ষাটাও একটু কম রাখতে হবে। আমরা দেখি, এখন শুরু থেকেই অনেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে চায়। বড় বেতন চায়, গাড়ি চায়। শুধু চাকরি পাল্টায়। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে এসব কিন্তু আসবেই। 

ভবিষ্যৎ এমডিদের উদ্দেশে

আমি যখন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ছিলাম, তখন বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে চিকিৎসকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। এমন ঘটনাও আছে, পণ্য নিয়ে ট্রাকে করে বেরিয়ে গেছি, বিক্রি শেষ করে ফিরেছি। এখন ভালো পদে থাকলে কেউ মাঠে-ঘাটে ঘোরার কষ্ট করতে চায় না। 

আমি একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার একটা ঘটনা বলি। প্রার্থীর কাছে জানতে চাইলাম, বিপণন সম্পর্কে কতটুকু জানেন। তিনি বললেন, বিপণন তাঁর কাজ নয়। একই ভাবে উৎপাদন ও বিক্রির বিষয়ে তিনি একই কথা বললেন। আমি জানতে চাইলাম, তাহলে আপনার কাজ কী? তিনি বললেন, সমন্বয়। আমার মনে হয়, নেতৃত্ব দিতে হলে সব বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। আপনি যদি শিল্পপতির সন্তান হন, তাহলে আপনি উদ্যোক্তাদের কাতারে পড়বেন। আপনি যদি পেশাদার ব্যবস্থাপক হতে চান, আপনাকে কষ্ট করতে হবে।