ভিনদেশের বন্দরে লাল-সবুজ পতাকা

নিয়ন্ত্রণকক্ষের মনিটর। দেখা যাচ্ছে মহাসাগর, সাগর ও বন্দরে জাহাজের অবস্থান
নিয়ন্ত্রণকক্ষের মনিটর। দেখা যাচ্ছে মহাসাগর, সাগর ও বন্দরে জাহাজের অবস্থান

এ মুহূর্তে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর বা ভারতের বন্দরের জলসীমায় উড়ছে বাংলাদেশি পতাকা। এই পতাকা বহন করছে বাংলাদেশি জাহাজ। বিদেশের বন্দরে দেশীয় পতাকা ওড়ানোতে এগিয়ে কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং। কারণ, বাংলাদেশের বহরে থাকা জাহাজের সিংহভাগই তাদের হাতে।

বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজ এখন ৫২টি। এর মধ্যে এককভাবে ১৮টি জাহাজই কবির গ্রুপের। এই গ্রুপের বহরে আগামী মাসে যুক্ত হচ্ছে আরও দুটি। এক দশক ধরে সরকারি-বেসরকারি দুই খাতের মধ্যে জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এ গ্রুপটি। 

আগ্রাবাদের বারিক বিল্ডিং মোড়ে কবির মনজিল থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় প্রতিষ্ঠানটির জাহাজের ব্যবসা। বুধবার ভবনের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, বড় মনিটরে পর্দায় ভেসে উঠছে সাগর, মহাসাগর ও বন্দরে থাকা প্রতিষ্ঠানটির জাহাজের সাংকেতিক চিহ্ন। পর্দায় চোখ রেখে দেখা যায়, এ মুহূর্তে জাপানের বন্দরে পতাকা উড়িয়ে পণ্য বোঝাই করছে এমভি জোয়াহের জাহাজটি। দুবাই থেকে আরব সাগর হয়ে ভারতের একটি বন্দরে ফিরছে ‘এমভি জাহান মনি’। দক্ষিণ চীন সাগর পেরিয়ে ভিয়েতনামের বন্দরে ভিড়েছে আয়শা সারওয়ার। 

বন্দর থেকে বন্দরে পণ্য নিয়ে জাহাজের ছুটে চলার এই বৈশ্বিক ব্যবসার সব সুফল প্রতিষ্ঠানটি একাই ঘরে তুলছে না। দেশের অর্থনীতিতেও ছোট্ট অবদান রেখে চলেছে তারা। বিদেশের বন্দরে পতাকা ওড়ানোর গৌরব তো আছেই। দেশের আমদানি পণ্য পরিবহন করে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে। আবার বিদেশের এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে পণ্য পরিবহন করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শতভাগ দেশীয় নাবিক নিয়োগ করে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও নিশ্চিত করছে তারা।

কবির গ্রুপের জাহাজ পরিচালনার ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সারওয়ার জাহান। নিজ অফিসে বসে প্রথম আলোকে জানালেন, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, কর্মসংস্থান এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ানো—চারটি অর্জনই এক খাত থেকে হচ্ছে। দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই এই চারটি খাতে দেশের অর্জনও বাড়তে থাকবে। সেই চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি।

 জাহাজ পরিচালনার মতো কঠিন ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া খুব সহজ নয়। এখানে পণ্য পরিবহনের ভাড়া ঠিক করতে হয় বিশ্বের সব জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ ভাড়া প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। এ বাজারে লোকসান দিয়ে হলেও ভাড়া নিতে হয়। কারণ, বসে থাকলে প্রতিদিন খরচ গুনতে হয় জাহাজভেদে আট-দশ লাখ টাকা। এই লোকসানের কথা মাথায় রেখে হাতে অগ্রিম পুঁজি রাখতে হয়। এরপরও থাকে শঙ্কা।

এই যেমন এক দশক আগে বৈশ্বিক মন্দার পর জাহাজের ভাড়া অস্বাভাবিক কমে যায়। সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্বের বাঘা বাঘা জাহাজ কোম্পানিও খাদে পড়ে যায়। বিশাল অঙ্কের লোকসানে পড়ে একজন আরেকজনকে অধিগ্রহণ করতে থাকে। কেউ দেউলিয়া হয়ে যায়। এ ঢেউ লেগেছে দেশেও। দেশে অনেকে ধাক্কা সামলাতে না পারলেও কবির গ্রুপ ঠিকই সংকট থেকে নিজেদের বের করে নিয়েছে। 

কীভাবে? কবির গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম জানালেন, শুধু নিজের কোম্পানির পণ্য পরিবহনের চিন্তা থেকে জাহাজ পরিচালনা ব্যবসা চালানো কঠিন। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই ব্যবসা করতে হবে। বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। নাহলে সংকটের সময় টিকে থাকা কঠিন।

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে জাহাজ ব্যবসা শুরু হয়েছে ৪১ বছর আগে। শুরুর দিকে এটলাস শিপিং, সমুদ্রযাত্রা শিপিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পথ দেখিয়ে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কিউসি বা এইচআরসির যুগও শেষ হয়েছে। সেখান থেকেই শুরু করেছিল কবির গ্রুপ। ২০০৫ সালে এমভি ফাতেমা জাহান জাহাজ দিয়ে শুরু হয় তাদের বৈশ্বিক ব্যবসার। তাতে কয়েক বছরের মাথায় দেশের শীর্ষস্থানে উঠে আসে তাদের নাম। বিদেশের বন্দর সবচেয়ে জাতীয় পতাকাও উড়ছে তাদের হাত ধরে। যেন বিদেশের বন্দরে এক টুকরো ভাসমান বাংলাদেশ। 

সব মিলিয়ে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৩০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।