ছোট পুঁজির উদ্যোক্তারা নানা সমস্যার মুখে রয়েছেন

আজিজার রহমান মিলটন  ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং
আজিজার রহমান মিলটন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং
>

ফাউন্ড্রি, হালকা প্রকৌশল, কৃষি ও খাদ্যপণ্য, সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, ওষুধ, প্লাস্টিকপণ্য, পাটসুতা, পোলট্রি খাদ্য, তৈরি পোশাকসহ নানা পণ্যের প্রচুর রপ্তানিমুখী কারখানা আছে। তারা সেবার বাড়তি দাম, কর ও ফির চাপে রয়েছে। এ নিয়ে বলেছেন বগুড়া বিসিক শিল্পমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজার রহমান মিলটন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ।

প্রথম আলো: দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্পের বড় বাজার বগুড়া। এখানকার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। এই শিল্পের বর্তমান সমস্যা কী?

আজিজার রহমান: বগুড়ায় সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প তৈরির প্রায় ৩৫০টি ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা রয়েছে হাজারখানেক। কিন্তু নানা সংকটে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকে তারল্যসংকটের কারণে এই শিল্পে ঋণ মিলছে না। এলসি পেতেও নানামুখী ঝামেলা হচ্ছে। কাঁচামাল রপ্তানিতেও নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

প্রথম আলো: হালকা প্রকৌশল শিল্পের কাঁচামাল রপ্তানিতে কী সংকট বিরাজ করছে?

আজিজার রহমান: ফাউন্ড্রি শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল পিগ আয়রন, সিলিকন, হার্ডকোক, কার্বন ব্লক, ফায়ার ব্রিকস, ম্যাঙ্গানিজ, ট্যালকম পাউডার, গ্রাফাইট পাউডার আমদানির ক্ষেত্রে আগে ৪ শতাংশ আগাম মূল্য সংযোজন কর বা অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) মওকুফ ছিল। এবারের বাজেটে ৪ শতাংশ এটিভির সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ ‘এটি কর’ যোগ করা হয়েছে। এদিকে কাঁচামালের আমদানি খরচ বেড়েছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে পণ্যের দাম খুব বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কৃষিপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট আরোপ করা হলেও বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ক কিন্তু মওকুফ করা হয়েছে। এটা দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করবে।

প্রথম আলো: ট্রেড লাইসেন্স ফি ও উৎসে কর বাড়লে ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ে। উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। কী পরিমাণ কী ফি বেড়েছে?

আজিজার রহমান: ট্রেড লাইসেন্স, উৎসে কর ও গ্যাস-বিদ্যুতের বিলসহ নানা খাতে খরচ বেড়েছে। কিছুদিন আগেও ট্রেড লাইসেন্স পেতে পৌরসভায় ফি জমা দিতে হতো ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এখন সেই ফি দিতে হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধির সঙ্গে শিল্পমালিকদের ওপর হোল্ডিং ট্যাক্সের বোঝাও চাপানো হয়েছে। ফলে বিসিক থেকে ইজারা নেওয়া প্লটের হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ বিনিয়োগভেদে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ফি গুনতে হচ্ছে। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য হোল্ডিং ট্যাক্স, উৎসে কর, ভ্যাট, প্রতি বর্গফুটে ১০০ টাকা হারে সাইনবোর্ড টাঙানোর ফি এবং বিবিধ ফি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া ঘুষও দিতে হচ্ছে বাড়তি। ২০১৫ সালের পরিপত্র অনুযায়ী জেলা শহরের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে উৎসে করের হার ছিল ৩০০ টাকা। গত ৬ আগস্ট থেকে তা বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেনশিল্পমালিকদের পকেট কাটতে বসে নেই বিসিকও। আগে প্লটগ্রহীতার সার্ভিস চার্জ ছিল প্রতি বর্গফুটে শতকরা ১ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে ৩ টাকা করা হয়েছে।

প্রথম আলো: গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে?

আজিজার রহমান: দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে একটি শিল্প ইউনিটে গড়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিল আসত। এখন সেই বিল দিতে হয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ বিল বাবদ এখন প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিটি শিল্প ইউনিটে গড়ে ১০ হাজার টাকা বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।

প্রথম আলো: উৎপাদন খরচের সঙ্গে পণ্যের দাম বেড়েছে। ক্রেতাদের ওপর কতটা প্রভাব পড়ছে?

আজিজার রহমান: সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে শিল্পশ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে দ্বিগুণ। ট্রেড লাইসেন্সের ফি, উৎসে করের হার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। এভাবে নানা খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় শিল্পকারখানায় গড়ে ২৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সেই তুলনায় পণ্যের দাম বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশ। কারণ, চীন, কোরিয়া, ভারতসহ নানা দেশ থেকে কৃষি ও হালকা প্রকৌশল শিল্প আমদানি হয়ে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম কম হওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে গিয়ে দাম বেশি বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

প্রথম আলো: হালকা ও প্রকৌশল শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?

আজিজার রহমান: ফাউন্ড্রি এবং হালকা ও প্রকৌশল শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও এদিকে কারও সুনজর নেই। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে জেলা শিল্প ও বণিক সমিতি থেকে উদ্যোক্তা সনদ নিতে হয়। প্রতিটি চালানেই এই সনদ নিতে অর্থ গুনতে হয়। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী ভারতে জেনারেল সেলস ট্যাক্স (জিএসটি) দিতে হয়। এই ট্যাক্সের কারণে সেখানকার রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে কম দামে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প কিনতে চান। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মাত্র ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এই প্রণোদনা আরও বাড়ানো দরকার।

দেশে মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প তৈরি হয় বগুড়ায়। ভারতে বছরে প্রায় ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানি হচ্ছে। তাই দেশটির আমদানিকারকদের আকৃষ্ট করতে বগুড়ায় বিমানবন্দর চালু করা দরকার। সব মিলিয়ে বগুড়ার ব্যবসা-বাণিজ্য নানামুখী সংকটে ধুঁকলেও ফাউন্ড্রি ও হালকা, প্রকৌশল শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন শুধু সরকারের সুনজর।