টাইটানিকের নিলাম গল্প

মিলভিনা ডিন
মিলভিনা ডিন

টাইটানিকের করুণ কাহিনি কার না জানা? বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে হলিউড থেকে এই জাহাজটির নামে একটা সিনেমা তৈরির পর সারা পৃথিবীর মানুষ পরিচিত হয়েছে টাইটানিকের সঙ্গে। নামটা উচ্চারিত হলেই একটা দীর্ঘশ্বাস এসে বাসা বাঁধে মনের কোমলতম স্থানে।

স্মরণ করিয়ে দিই, ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে, মানে যা ১৫ এপ্রিলে এসে পড়েছিল, ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। এ জাহাজ যে ডুবে যেতে পারে, সে কথা জাহাজটি ডোবার আগে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কেউ তাঁদের ভাবনাতেও জায়গা দেননি।

টাইটানিক তো ডুবে গেল। কিন্তু তাতে শেষ হয়ে গেল না টাইটানিক–সংক্রান্ত আলোচনা। এবং এই আলোচনায় যুক্ত হলো নিলামের ঘটনাগুলো। সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থাকা টাইটানিক থেকে তুলে আনা কিছু কিংবা টাইটানিক–অভিযাত্রী, যিনি কোনোমতে মৃত্যু এড়াতে পেরেছেন, টাইটানিকে তাঁদের ব্যবহার্য বস্তু নিলামকারীদের জন্য খুবই ওজনদার।

আটলান্টিক মহাসাগরের যেখানটায় টাইটানিক শুয়ে আছে, সেখানে বহুবার অভিযান চালিয়েছে মানুষ। তবে ১৯৮৫ সালে মার্কিন–ফরাসি অভিযাত্রীরা সাগরের অতলে প্রথম খুঁজে পান টাইটানিককে। এই অভিযাত্রার দলনেতা ছিলেন সমুদ্রে গুপ্তধন খুঁজে বেড়ানোতে অভিজ্ঞ রবার্ট ব্যালার্ড ও ঝাঁ লুই মিশেল। পানির নিচে তাঁরা টাইটানিক জাহাজটি খুঁজে পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত সেখান থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এই পাঁচ হাজার দ্রব্যের তালিকা আমরা দিতে পারব না, শুধু বলতে পারব, তারই কিছু উঠেছে নিলামে। সে নিলাম নিয়েই আমরা এখন কথা বলব।

টাইটানিকের প্রথম শ্রেণির স্টুয়ার্ড ছিলেন এডমুন্ড স্টোউন। তাঁর হাতে ছিল একটি ঘড়ি। সে ঘড়িটি নিলামে বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ডলারে। এই ঘড়ির একটা বিশেষত্ব আছে। ঘড়ির সময়টা স্থির হয়ে আছে রাত ২টা ১৬ মিনিট। যে সময়টায় এডমুন্ড স্টোউনের সঙ্গে সলিলসমাধি লাভ করেছিল ঘড়িটি।

হার্টলির বেহালা
হার্টলির বেহালা

টাইটানিকের যে অর্কেস্ট্রা ছিল, তার সদস্য ছিলেন উয়োলেস হার্টলি। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে রয়েছে এক হীরণ্ময় দৃশ্য। টাইটানিক যখন ডুবছে, তখনো জাহাজের যাত্রীদের মনবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অর্কেস্ট্রা দল বাজিয়ে চলেছিল। নিজেরা ডুবে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের যন্ত্র থেকে ভেসে আসছিল সুর। হার্টলি নিজের বেহালাটাকে খুব ভালোবাসতেন। টাইটানিক ট্র্যাজেডির দুই বছর আগে তাঁর প্রেমিকা এ বেহালাটি উপহার দিয়েছিলেন হার্টলিকে। মৃত্যুর সময়ও এই বেহালা হাতছাড়া করেননি হার্টলি। লন্ডনের এক নিলামঘরে হার্টলির বেহালাটি বিক্রি হয়েছে ৯ লাখ পাউন্ডে।

জর্জ তুলোক নামের এক ব্যবসায়ী টাইটানিকে পাওয়া যেকোনো বস্তু নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন। এই কাজে তিনি ব্যয় করেছিলেন ২০ মিলিয়ন মানে ২ কোটি ডলার। তিনি কড়ায়–গন্ডায় আদায়ও করে নিয়েছেন প্রতিটি পয়সা, লাভও করেছেন বিস্তর। টাইটানিক থেকে উদ্ধার করা এমন কোনো জিনিস নেই, যা তিনি বিক্রি করেননি। এমনকি সেখানে পাওয়া কয়লার টুকরাও তিনি বিক্রি করেছেন সুন্দর ছোট্ট নয়নাভিরাম বাক্সে পুরে।

এডমুন্ড স্টোউনের ঘড়ি
এডমুন্ড স্টোউনের ঘড়ি

এবার ২০০৯ সালের একটা কাহিনি বলা যাক। ব্রিটিশ নিলামঘর ‘হেনরি অলরিজ অ্যান্ড সন’ সে বছর নিলামে তুলল মিলভিনা ডিন নামের এক নারীর ব্যবহার্য কিছু দ্রব্য। সে সময় মিলভিনার বয়স ছিল ৯৭ বছর। বলে রাখি, টাইটানিকের যাত্রীদের মধ্যে মিলভিনা ছিলেন বয়ঃকনিষ্ঠ। ১৯১২ সালে তাঁর বয়স ছিল আড়াই মাস। কিন্তু এই জিনিসপত্রের পেছনে এ রকম একটা কাহিনি থাকার পরও মিলভিনার এই জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছিল না নিলামে। এই বৃদ্ধ জিনিসগুলো বিক্রি করতে চাইছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকার খরচ জোগানোর জন্য। বিক্রি যখন হচ্ছিল না, তখন নিলামে অংশগ্রহণকারী একজন কিনে নেন আড়াই মাস বয়সী মেয়েটাকে যে থলেতে পেঁচিয়ে ওঠানো হয়েছিল টাইটানিকে, সেই থলেটি। তিনি তা কিনে নেন দেড় হাজার পাউন্ডে। তারপর তিনি সেই টাকা তো দিলেনই, সঙ্গে মিলভিনকে উপহার হিসেবে ফেরত দেন তাঁর থলেটিও।

২০০৬ সালে নিউইয়র্কের এব নিলামে অনেক কিছুর মধ্যে উঠেছিল দুটি ব্রোঞ্জের স্মারক। একটিতে লেখা ছিল ‘এস এস টাইটানিক’, অন্যটিতে ‘লিভারপুল’। সংগ্রাহকদের মধ্যে দারুণ আলোড়ন তুলেছিল এই স্মারক দুটি। শেষ পর্যন্ত প্রথমটি বিক্রি হয়েছিল ৭২ হাজার ডলারে আর দ্বিতীয়টি ৬০ হাজার ডলারে।

ভাববেন না, টাইটানিকের সবকিছুই নিলামে বিক্রি হয়েছে। কিছু হয়েছে চুরি। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির নেশভিলের ওপরিদল্যান্ড হোটেলে টাইটানিকে পাওয়া জিনিসপত্তরের প্রদর্শনী হচ্ছিল। সে প্রদর্শনী থেকে চোরের দল টাইটানিকে পাওয়া ৯টি কাগজের টাকা আর ১০টি কয়েন দিব্যি গায়েব করে দিয়েছিল।

তথ্য: আই–ফ্যাক্টডটরু