সংখ্যার ভাষায় কথা বলি

‘ব্যবসা কেমন চলছে?’ উদ্যোক্তার সঙ্গে দেখা হলে সামাজিক বা ব্যবসায়িক পরিসরে, খুব চলতি একটা প্রশ্ন। উত্তর মেলে, ভালোই। সামাজিক পরিসরে এর বেশি এগোনো হয়তো অনধিকার চর্চা হয়। কিন্তু ব্যবসায়িক সম্মিলনে এটি খুবই বাজে একটা উত্তর। উত্তরদাতাকে ভালোর প্রমাণস্বরূপ বলতে হয়, কত বিক্রয় বা লাভ বেড়েছে। নচেৎ প্রশ্নকর্তা থেকে ছুটে আসে প্রশ্নবাণ। একটা কথা আছে, যা পরিমাপ করা যায় না, তা ব্যবস্থাপনা করা যায় না। আর কে না জানে, পরিমাপ মানে সংখ্যা। সেটা বিক্রয় বা লাভের টাকার অঙ্ক বা উৎপাদন বা রপ্তানির ওজন বা পিস হতে পারে। একজন উদ্যোক্তাকে নিচের পাঁচটি সংখ্যা বা হিসাবের দিকে নজর রাখতে হবে 

১. বিক্রি

যে কোনো ব্যবসায় কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদন, সরবরাহ বা বিক্রি করে। কিন্তু শুধু বিক্রির সংখ্যা জানলে কি বোঝা যাবে ভালো না খারাপ? বিক্রির তুলনা করা উচিত সমান্তরালভাবে অর্থাৎ গত মাসের সঙ্গে বা গত বছরের সঙ্গে। ধরা যাক শামীম ও হামিম দুই বন্ধু একই পণ্যের ব্যবসা করে। শামীমের বছরে বিক্রি ১০ হাজার টাকা আর হামিমের ১ লাখ টাকা। আপাতদৃষ্টিতে হামিমের বিক্রি ভালো। কিন্তু শামীম খুচরা বিক্রেতা, লাভের হার ১৫ শতাংশ। হামিম পাইকারি বিক্রেতা, লাভের হার ১ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে শামীমের লাভ ১ হাজার ৫০০ টাকা আর হামিমের ১ হাজার টাকা। দুজন কিসের ব্যবসা করে, কোথায় করে, কত দিন ধরে করে এসব অনেক কিছু না জেনে ভালো বা খারাপ বলা দুরূহ। 

২. মোট মুনাফা

বিক্রি থেকে পণ্য উৎপাদন বা ক্রয় বাবদ খরচ বাদ দিলে মোট বা গ্রস মার্জিন পাওয়া যায়। এটা জানা খুব জরুরি। দশ টাকায় পণ্য কিনে বা বানিয়ে নয় টাকায় বিক্রি করলে তাকে ব্যবসা বলা যায় না। মোট মুনাফা থেকে প্রশাসনিক ব্যয়, বিপণন, অর্থায়ন ব্যয় বাদ দিলে নিট মুনাফা পাওয়া যায়। উপযুক্ত হিসাব ব্যবস্থাপনা না থাকলে উদ্যোক্তা লোকসানের কারণ বুঝতে পারে না। অন্ধের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। বিক্রি বাড়ায়, নতুন পণ্য নামায়, বিপণন ব্যয় বাড়ায়। কিন্তু মোট লোকসান থাকলে, পণ্যের বিক্রি বাড়লে লোকসান আরও বাড়বে। 

৩. নিট লাভ

মোট মুনাফা থেকে কর্মসম্পাদন (অপারেটিং) ব্যয়, সুদ ও কর বাদ দিলে নিট মুনাফা পাওয়া যায়। কারও নিট মুনাফা ১ কোটি টাকা হলে আমরা কি ভালো না খারাপ বলব? আসলে ভালো খারাপ বলতে গেলে তুলনা করতে হবে নিজের (যেমন গত বছর, বিক্রয়, পুঁজি সম্পদ ইত্যাদি) এবং অন্যের (শিল্পের গড়, সমমানের প্রতিযোগী) সঙ্গে। 

৪. বিক্রয় আবর্তন

সুমন ও সুজন দুই বন্ধু। ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। সুমন ১০ শতাংশ মুনাফা করে আর সুজন ১৫ শতাংশ। সুমন গড়ে দুই মাসে তার মালামাল বিক্রি করতে পারে। অবশ্য শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগেই আবার মালামাল নিয়ে আসে। অর্থাৎ বছরে তার বিক্রয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। সুজনের মালামাল (বিক্রি করে) শেষ হতে ৪ মাস লাগে। তার বিক্রি প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বছরে সুমনের লাভ ৬ হাজার আর সুজনের লাভ ৯ হাজার টাকা। বিক্রয়কে গড় কাঁচামালের মূল্য দিয়ে ভাগ করলে বিক্রয় আবর্তন মেলে। 

৫. চলতি মূলধন

মজুত মাল, নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা টাকা, বাকিতে বিক্রি বাবদ পাওনা টাকা মিলে হয় চলতি সম্পদ। বাকিতে ক্রয় বাবদ দেনা, স্বল্পমেয়াদি ঋণ ইত্যাদি মিলে হয় চলতি দেনা। চলতি সম্পদ চলতি দেনার ১২০ শতাংশ থেকে ২০০ শতাংশ হওয়া উচিত। চলতি মূলধন কমে গেলে ব্যবসা আটকে যায়। 

শওকত হোসেন: ভেঞ্চার বিনিয়োগ বিষয়ক পরামর্শক