মানা হয়নি ফরাসউদ্দিন কমিটির সুপারিশ

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্ব গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ সুপারশ করলেও মানা হয়েছে অল্প কয়েকটি। কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এমনকি সামগ্রিক ব্যাংক খাত পরিচালনা বিষয়ে করা সুপারিশও সরকার আমলে নেয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনব্যবস্থার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। আর রিজার্ভ চুরির ঠিক পরপরই সুইফট থেকে আরটিজিএস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফরাসউদ্দিন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। 

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সব সার্ভার রাখা আছে প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায়। আর ব্যাকআপ সার্ভার রাখা হয়েছে মিরপুরের বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে। তবে আগের মতোই ব্যাক-অফিস পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের (এবিডি) মাধ্যমে। এই কক্ষে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। রিজার্ভ চুরির সময় যাঁরা ওই বিভাগে কর্মরত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখনো ওই বিভাগে রয়ে গেছেন। এর মধ্যে মুখলেসুর রহমান, জুবায়ের বিন হুদা, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, শেখ রিয়াজউদ্দিন, রফিক আহমেদ মজুমদার, মইনুল ইসলাম এখনো অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগে কর্মরত। এর মধ্যে ১৫ জানুয়ারি যুগ্ম পরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপমহাব্যবস্থাপক হয়েছেন জুবায়ের বিন হুদা। আর আইটি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক রাহাত উদ্দিন এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে কর্মরত। 

জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে, স্বাভাবিক নিয়মে সবার পদোন্নতি ও বদলি অব্যাহত আছে। 

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। একই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুজন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

কমিটির মন্তব্য ও সুপারিশ

যদিও তদন্ত কমিটি দায়িত্বহীনতা, কাজে গাফিলতি ও অদক্ষতার জন্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাত কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে আইটি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক রাহাত উদ্দিন খানকে নিয়ে কমিটির মন্তব্য হচ্ছে, সুইফট-আরটিজেএস সংযোগকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যা করণীয় ছিল, তার অবহেলা করে তিনি দেশের ক্ষতি করেছেন। আর অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের জুবায়ের বিন হুদা, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, শেখ রিয়াজউদ্দিন ও রফিক আহমেদ মজুমদারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে চুরি ঘটনা সম্পন্ন হতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া শেখ রিয়াজউদ্দিন ও মইনুল ইসলাম তাঁদের পাসওয়ার্ড চুরি (তদন্ত কমিটির ভাষায় কম্প্রোমাইজড) হতে দিয়ে বিপত্তির সৃষ্টি করেছেন। 

তদন্ত কমিটি এঁদের মধ্যে দুই কর্মকর্তার বিষয়ে আরও বেশি তদন্ত করার সুপারিশ করেছে। কমিটি বলেছে, উপপরিচালক জি এম সালেহীন আবদুল্লাহ এবং মুখলেসুর রহমান রিজার্ভ চুরির সহায়তাকারী না অংশীদার, তা নিয়ে তদন্ত করা জরুরি। কেননা, তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেটা সেন্টার থেকে অনেকবারই সুইফট বার্তা প্রেরণকারী মেইন সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। জি এম সালেহীন আবদুল্লাহর ল্যাপটপ থেকে ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বরের পর নয়বার এ ধরনের যোগাযোগ করা হয়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি সালেহীন আবদুল্লাহর ল্যাপটপের লগবার্তাগুলো মুছে ফেলা, পরের দিন ৪ ফেব্রুয়ারি অর্থ হস্তান্তরের জন্য ৩৫টি বার্তা পাঠানো এবং ভোররাত ৪টা ২৩ মিনিটে লগআউট হওয়া যখন সংগঠিত হয়, তখন উপপরিচালক মুখলেসুর রহমান ডেটা সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন। 

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলনকক্ষে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে গভর্নর আর কোনো জবাব দেননি। 

 তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে সিআইডির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ফলে এ ঘটনায় কেউ জড়িত বা দোষী কি না, তা জানা যায়নি। এ কারণে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

 সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এ বক্তব্য দিলেও বাংলাদেশ গত সাড়ে তিন বছরে অভ্যন্তরীণ কোনো তদন্ত করেনি, কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। বরং পদোন্নতি ও বদলি অব্যাহত রেখেছে। 

আবার যাতে না ঘটে

একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে কমিটির অন্যতম সদস্য ড. কায়কোবাদের তত্ত্বাবধানে তিনজন দেশি বিশেষজ্ঞের একটি দল বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তরের বার্তাপ্রবাহ ছাড়াও প্রযুক্তিগত সব বিষয়ে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়। কমিটির আশা ছিল সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক তা দ্রুতগতিতে বিবেচনা করবে। 

এ ছাড়া কমিটি সুইফটকে আরটিজিএস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা আলাদা পরিচালনার এবং একটি ব্যাকআপ সার্ভার ঊর্ধ্বতন কারও কক্ষে সংরক্ষণ, সুইফটে বার্তা প্রদানকারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিশেষ ভাতা এবং রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরীক্ষারব্যবস্থা চালু এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৮০ শতাংশ মার্কিন ডলারে না রেখে বিশ্বের আরও কয়েকটি প্রধান মুদ্রায় সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছিল।

তদন্ত কমিটির আরও সুপারিশ ছিল চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে, ভুলভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। কোনো আগ্রাসী তৎপরতা নয়, বরং নিউইয়র্ক ফেড, সুইফট, আরসিবিসি-সবার সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র অথচ দৃঢ় ভাষায় যোগাযোগ করে সহযোগিতা চাইতে হবে। খুব ভালো হয় যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক কৌশলী তৎপরতায় এবং অত্যন্ত যোগ্য আইনি পরামর্শে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। 

 ব্যাংক যেভাবে চলবে

ফরাসউদ্দিন কমিটি ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালনা নিয়েও বেশ কিছু সুপারিশ করে। কমিটি বলেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের টানাপোড়েন আর চলতে দেওয়া যায় না। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক সংস্কারের পরিমণ্ডলে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সার্বিক নজরদারির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া যেতে পারে। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিমা, বিশেষায়িত ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নজরদারি করতে পারে। এ ছাড়া একটি দক্ষ ও দায়িত্বশীল ব্যাংকব্যবস্থা গড়তে সরকারের ট্রেজারি সোনালি ব্যাংক ছাড়া অন্য সব রাষ্ট্র খাতের ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর অথবা শেয়ারবাজারে পুঁজি বিক্রি করে জনসাধারণের অংশগ্রহণে তাদের মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকসহ করপোরেট খাতে একীভূত ও একত্রকরণ (মার্জার ও অ্যাকুইজিশন) আইন পাস করার কাজটি দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা যেতে পারে। 

তদন্ত কমিটি গভর্নরের মেয়াদ বাড়িয়ে একবারেই পাঁচ বা ছয় বছর এবং গভর্নরের মানক্রম কমপক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সমান বা আরও এগিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কমিটির আরও সুপারিশ হচ্ছে এটিএম মেশিন থেকে বারবার অর্থ চুরির ঘটনার আদ্যোপান্ত তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আরোপ, জনসাধারণের অপূরণীয় ক্ষতি রোধে মোবাইল ব্যাংকিংকে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা এবং দেশে-বিদেশে লেনদেন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও রোববার করা যেতে পারে। 

সুপারিশ মানা হলো কতটা

সব মিলিয়ে সুপারিশ মানা হয়নি বললেই চলে। এমনকি এ নিয়ে আর কোনো আলোচনাই হয়নি। তবে রিজার্ভ চুরি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে-বিদেশে মামলা করেছে। এর মধ্যে দেশে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় প্রথম মামলাটি করা হয়। ১৬ মার্চ মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থাকে (সিআইডি)। সে থেকে এখন পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি সিআইডি। এ নিয়ে ৩৫ বার আদালতের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ পাল্টানো হয়েছে।