৮০-২০ নীতি সফলদের মূলমন্ত্র

নিজের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। বছরের শুরুতে খেয়াল করলাম, মোবাইল ডিভাইসে প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে। তিন দিন ধরে নিজের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ৮০ শতাংশ সময়েই নোটিফিকেশন চেক করতে গিয়ে ফোন হাতে নেওয়া হচ্ছে। ফোনের সেটিংসে ঢুকে মেইল-ফেসবুকসহ যেসব অ্যাপ্লিকেশন থেকে নোটিফিকেশন আসে, সবই অফ করা হলো। ফলাফল? মোবাইলে সময় নষ্ট হচ্ছে এখন অনেক কম। সারা দিনের সময়ও যেন বেড়ে গেল কয়েক ঘণ্টা।

কীভাবে এল?

এতক্ষণ আসলে বলা হচ্ছিল ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ পারেতোর ১৯০৬ সালে দেওয়া এক তত্ত্বের কথা, যাঁর নামানুসারে একে ‘পারেতোর ৮০-২০ নীতি’ বলা হয়। গবেষণায় তিনি দেখলেন, ইংল্যান্ডের ২০ শতাংশ লোকের কাছেই ৮০ শতাংশ সম্পত্তি। পরে দেখলেন নিজের বাগানে ছিটানো ২০ শতাংশ মটরদানা থেকেই ৮০ শতাংশ চারা বেরিয়েছে। নীতিটা তাই এমন, ২০ শতাংশ চেষ্টা দিয়েই ৮০ শতাংশ ফল আসে। অবশ্য একদম অঙ্ক কষেই যে ৮০-২০ হবে, এমনটা নয়। ৮৫-১৫, ৯০-১০, ৯৫-৫—এ রকম অনেক কিছুই হতে পারে।

১৯৪০-এর দশকে ড. জুরান শিল্পকারখানায় ‘কোয়ালিটি কন্ট্রোল’ করতে প্রয়োগ করলেন এই নীতি। দেখলেন, পণ্যের ৮০ শতাংশ সমস্যাই হয় যন্ত্রের ২০ শতাংশ সমস্যার জন্য। কেবল ওই ২০ শতাংশ সমস্যা সমাধানেই পণ্যের সামগ্রিক মান বাড়ল কয়েক গুণ।

আরও উদাহরণ

আপনি ফ্রেঞ্চ কিংবা চায়নিজ ভাষায় দক্ষ হতে চাইলে ওই ভাষার কয়েক লাখ শব্দ আর ব্যাকরণ জানতে হবে না। মাত্র ২০ শতাংশ শব্দ দিয়েই আপনি ৮০ শতাংশ কথাবার্তা সারতে পারবেন। উইন্ডোজের ২০ শতাংশ বাগই ৮০ শতাংশ ক্রাশের কারণ। অন্য যেকোনো সফটওয়্যারের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে।

এবার আপনার প্রিয় গায়কের কথা ভাবুন। দেখবেন, তাঁর ২০ শতাংশ গানই ৮০ শতাংশ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। হলিউডের ২০ শতাংশ ছবিই বক্স অফিসের ৮০ শতাংশ লাভ এনে দেয়।

আমাদের ইউটিউব আর ফেসবুকের ভিডিও অ্যানালিটিকস থেকে দেখা যায়, ২০ শতাংশ ভিডিও থেকেই আমাদের ৮০ শতাংশ ভিউ। কিছু সুপারশপ কিংবা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি, ২০ শতাংশ পণ্যই তাদের ৮০ শতাংশ বিক্রি এনে দেয়। আবার তাদের কেবল ২০ শতাংশ গ্রাহকই ৮০ শতাংশ অভিযোগগুলো করেন।

কীভাবে শুরু করবেন?

প্রথম কাজ হলো, এই সপ্তাহে কোন কাজগুলো করবেন না, তার একটি তালিকা অর্থাৎ একটা ‘নট-টু-ডু লিস্ট’ বানাবেন। মানুষের মনস্তত্ত্ব হলো, একটা বিশাল ‘টু-ডু লিস্ট’ বানিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আগে শেষ করা এবং ঘ্যাঁচাং করে একটার পর একটা কাজ কেটে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা। দিন শেষে আপনি ব্যস্তই থেকে যান অথচ উন্নতির বেলায় লবডঙ্কা।

সারা দিনের কাজকে আতশি কাচের নিচে রেখে দেখুন, কোন কাজগুলো আপনার সময় সবচেয়ে বেশি নষ্ট করছে। ঘন ঘন মেইল চেক, সব ফোন রিসিভ, মোবাইলের নোটিফিকেশনে নজর—এসবই পাবেন তালিকায়। দুপুর ১২টা আর বিকেল ৪টাতেই কেবল মেইলের উত্তর দিন। যেসব ফোন পরে কলব্যাক করলেও হবে, তা পারতপক্ষে রিসিভ করবেন না। স্মার্টফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন। নিজের মেধা-শ্রম দেবেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আগে শেষ করতে।

দিনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কাজের তালিকা তৈরি করে ঠিক করুন এর মধ্যে ঠিক কোন কাজটি করলে পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। বাকি চারটি কেটে দিন এবং কেবল ওই কাজেই সবচেয়ে বেশি সময় দিন।

যে ২০ শতাংশ পণ্য আপনাকে ৮০ শতাংশ আয় দিচ্ছে, এগুলোর মান বাড়াতেই মন দিন সবচেয়ে বেশি। বেশি গ্রাহক বা ক্লায়েন্ট মানেই সব সময় বেশি আয় নয়। যে ২০ শতাংশ গ্রাহক আপনাকে ৮০ শতাংশ লাভ দিচ্ছে, তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক গাঢ় করে আরও কাজ বা অর্ডার নিন।

ছোট্ট একটি তালিকা করুন, কোন ২০ শতাংশ মানুষ আর কোন ২০ শতাংশ গ্রাহক কিংবা কাজ আপনার ৮০ শতাংশ মানসিক যন্ত্রণা-রাগ-সময় অপচয়ের কারণ। আর কোন ২০ শতাংশ এনে দিচ্ছে আর্থিক ও মানসিক তৃপ্তি।

শেষ প্রশ্ন

কোনো কাজে বেশি চেষ্টা বা সময় দেওয়া মানেই কাজটার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া নয়। অফিসে বেশিক্ষণ বসে থাকা মানেই নিশ্চিত প্রমোশন নয়। ব্যস্ত থাকা আর কার্যকরী হওয়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কীভাবে কাজটা করা হচ্ছে বা কোন নির্দিষ্ট কাজে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, সেটাই বরং কার্যকর ফল এনে দেয়। তাই কেবল একটাই প্রশ্ন করুন নিজেকে—

আমি কি কাঙ্ক্ষিত ফলপ্রাপ্তির জন্য কাজ করছি নাকি নিছক ব্যস্ততার ভান করে যাচ্ছি?


প্রিয়ম মজুমদার : সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্যাভিলিয়ন