সিরিয়ার ক্রীতদাস থেকে ব্যাবিলনের ধনী ব্যবসায়ী

ব্যাবিলন প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যবান আর সম্পদশালী শহর ছিল। প্রায় চার হাজার বছর আগে ইউফ্রেতিসের তীরে থাকা এই ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, দুর্ভেদ্য প্রাচীর, প্রশস্ত রাস্তা, অপরূপ উপাসনালয়ের সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দারাও তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তবান লোক ছিল। এই ব্যাবিলনেরই ধনী উট ব্যবসায়ী ডাবাসির একসময় সিরিয়ায় ক্রীতদাস ছিল। এর আগে ব্যাবিলনে সে লাগামহীন অর্থব্যয়ের কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ায় পরিবার-স্ত্রী সব ছেড়ে শহর থেকে পালিয়েছিল।

কিন্তু সে তো আর জন্ম থেকেই ক্রীতদাস ছিল না। তাই তার মন পড়ে রইল ব্যাবিলনের মুক্ত জীবনে। নিজেকে প্রশ্ন করত বারবার, ‘আমি কি সারা জীবন ক্রীতদাস হয়ে থাকতে চাই, নাকি মুক্ত হতে চাই? আমার ঋণ না হয় আমার শত্রু, যারা আমাকে বিশ্বাস করে ঋণ দিয়েছিল, তারা তো আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। যদি ক্রীতদাস হওয়ার মানসিকতা থাকে, তাহলে এখানেই হাল ছেড়ে দেব। আর যদি স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাই, তাহলে ঋণ শোধ করে স্ত্রী আর পরিবারকে সুখী রেখে আরও পরিশ্রমী-উদ্যোগী হতে হবে।’

ডাবাসির সিরিয়ার ক্রীতদাসের জীবন থেকে ব্যাবিলনে আবার ফিরে গিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সিদ্ধান্ত নিল, বিপুল ঋণের বোঝা সে শোধ করবেই। পালিয়ে বাঁচার চেয়ে পাওনা শোধের চেষ্টা বরং সহজতর।

ঋণের তালিকা করে ডাবাসির দেখল, ১০ জনের কাছে সে মোট ৪৫ রৌপ্যমুদ্রা আর ২৭ তাম্র মুদ্রা ধার নিয়েছে। সে ঠিক করল, তার মাসিক উপার্জনের দুই-দশমাংশ দিয়ে সে পাওনা মেটাবে। একেক করে সব পাওনাদারের সঙ্গেই কথা বলে ডাবাসির ঠিক করল, প্রত্যেককেই প্রতি মাসে অল্প অল্প করে শোধ করবে। কয়েকজন তার সঙ্গে চোটপাট করল এবং তাদের পাওনা আগেই মেটাতে বলল। কিন্তু ডাবাসির তাদের বোঝাল এভাবে, কাউকে আগে শোধ করে অন্য কাউকে বঞ্চিত রাখলে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। আর এমনিতে তো সে এত দিন পাওনা মেটাতে পারেনি, এখন বরং নিয়ম করে সবাইকে অল্প অল্প শোধ করতে গিয়ে সময় বেশি লাগলেও সবাই সমান তুষ্ট থাকবে।

আর সে ঠিক করল, অন্যদের পাওনা শোধ করলেও উপার্জনের দশ ভাগের এক ভাগ প্রথমেই সে নিজের জন্য আলাদা করে রেখে দেবে জ্ঞানী আরকাডের উপদেশ মেনে। হ্যাঁ, এই এক ভাগ দিয়েও সে পাওনা মেটাতে পারত অন্যদের। কিন্তু সে নিজেকে বোঝাল এভাবে, নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করতে থাকলে আত্মতৃপ্তি এবং সাহস বাড়তে থাকবে। উপার্জনের দশ ভাগের বাকি সাত ভাগ দিয়ে সে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের খরচ মেটানো শিখে নেবে, এতে তার আর তার স্ত্রীর যত কষ্টই হোক না কেন।

প্রথম মাসে ডাবাসির আয় করল ১৯ রৌপ্যমুদ্রা। পরিকল্পনা অনুযায়ী দশ ভাগ করে নিজের জন্য এক ভাগ প্রথমেই আলাদা করে রাখল, দুই ভাগ দিয়ে দশজনের পাওনাই অল্প করে করে শোধ করল আর বাকি সাত ভাগ দিয়ে নিত্যকার খরচা মেটাল। পরের মাসে ১১ রৌপ্যমুদ্রা আয় হওয়ায় ওই মাসে কম সঞ্চয় করে কম পাওনা মেটাল আর কম খেয়ে-পরে মাস কাটাল সে, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল। এরপরের মাসে ভালো আয় হলো; ৪২ রৌপ্যমুদ্রা। এবারও ওই একই অঙ্ক।

এভাবে তিন মাস পর ডাবাসির দেখল, থাকা-খাওয়া-পরার খরচ মিটিয়েও ১৫ রৌপ্যমুদ্রার মতো পাওনা সে মিটিয়ে ফেলেছে আর নিজের জন্য সঞ্চয়ও করে ফেলেছে ৭ রৌপ্যমুদ্রা। সঞ্চয়ের পরিমাণ জেনে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল ডাবাসিরের। আরও পরিশ্রম করতে থাকল সে। এক বছরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সব ঋণ শোধ করার পরে সে দেখল, ২৫ রৌপ্যমুদ্রা জমিয়েও ফেলেছে নিজের জন্য। আগের পাওনাদার বন্ধুরাও তার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতে থাকল আর সে নিজেও সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে–ফিরতে শুরু করল।

আর এই নিয়মটা ডাবাসির সব ঋণশোধের পরেও জারি রাখল, তবে একটু ভিন্নভাবে। দশ ভাগের এক ভাগ প্রথমেই নিজের জন্য, সাত ভাগ দিয়ে নিত্যকার খরচ আর বাকি দুই ভাগ দিয়ে এবার বিনিয়োগ করা শুরু করল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। কারণ, সাত ভাগ দিয়ে মাসিক খরচ চালাতে সে অভ্যাস করে ফেলেছিল। উপার্জন-অর্থ বাড়ার পরে বিলাসদ্রব্য কিনতে খুব ইচ্ছে করলেও নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল সে। ব্যয় না বাড়িয়ে বরং সঞ্চয়-বিনিয়োগে মন দিল।

পাঁচ হাজার বছর পরে এসে এই একই নিয়ম মেনে আপনি ঋণমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে দেখবেন কি?

শেষ কথাটা আবারও বলি: মোট আয়ের একটা অংশ নিজের জন্য রাখুন।

(সূত্র: দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যাবিলন—জর্জ ক্লেসন)