এডিপি বাস্তবায়ন: ঘুরেফিরে সেই '৯'

অর্থবছরের শুরুতে সাধারণত প্রকল্পের কাজ তেমন এগোয় না বা মন্ত্রণালয়গুলো প্রকল্পের কাজ শুরু করতেই পারে না। এসব পুরোনো খবর। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বছরের শুরুর দিকে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে একদমই পারদর্শিতা দেখাতে পারে না। ঘুরেফিরে সেই একই নাম আসে। গত তিনটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিবারই ৯টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ তাদের বরাদ্দের ১ শতাংশ অর্থও খরচ করতে পারেনি। প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের টাকা খরচে যেন মনোযোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এই ৯টি মন্ত্রণালয় হলো বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। কারণ এসব মন্ত্রণালয়ের কোনোটিই গত তিন অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বরাদ্দের ১ শতাংশ টাকাও খরচ করার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) আলোচিত এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পারফরম্যান্সে কোনো রকম অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এ বছরে এই ৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে ১৫৮টি প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের অনুকূলে এবারের এডিপিতে বরাদ্দ আছে ১১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। তা থেকে দুই মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৫৪ কোটি টাকা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ২০টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনো টাকা খরচ হয়নি। একই দশা দেখা গেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন ৮টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ১১১ কোটি টাকা। অথচ এই বরাদ্দের বিপরীতে মন্ত্রণালয়টির খরচের খাতা শূন্য।

আলোচ্য ৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বেশি, ৪৬টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ আছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রথম দুই মাসে খরচ মাত্র ৯ কোটি টাকা।

আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, আগের দুই এডিপিতেও ওই ৯টি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রথম দুই মাসে ১০০ কোটি টাকাও খরচ করা সম্ভব হয়নি।

টাকা খরচ করতে না পারার পেছনে প্রকল্প কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও সুষ্ঠু ক্রয় পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছর শুরু হওয়ার আগেই ক্রয় পরিকল্পনা থাকা উচিত, যাতে বাজেট পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া সম্ভব হয়। এতে প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হবে, অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে।

চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এবারের এডিপিতে ১ হাজার ৫৬৫টি প্রকল্প আছে। প্রথম দুই মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে অবশ্য বাস্তবায়নের হার ছিল ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ।

গত অর্থবছর থেকে বছরের শুরুতেই মন্ত্রণালয়গুলোকে বরাদ্দের সব টাকা খরচের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন টাকা খরচের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো ছাড়পত্র নিতে হয় না। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এডিপি বাস্তবায়ন আগের সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ছোট-বড় সব মন্ত্রণালয়েরই উদ্যোগী থাকা উচিত। কেননা, এডিপির অর্থ খরচ হলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে নজরদারি বাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ, অর্থায়নের সমস্যার কারণে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। প্রকল্পের ধরনের ওপর সেটা নির্ভর করে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বেশ কিছু অনুশাসন দিয়েছেন। যেমন প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করা, জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রকল্প নেওয়া। কিন্তু এই অনুশাসন বাস্তবায়ন ও নজরদারিতে তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি।

ইতিমধ্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।