চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে স্বাগতম

কে জানত আমাদের ছোটবেলার প্রিয় স্মৃতির সঙ্গে জড়িত কোডাক কিংবা ফুজি ফটোফিল্ম দিয়ে কেউ একদিন আর ছবি তুলবে না? একসময়ের দেড় লাখ কর্মীর প্রতিষ্ঠান কোডাক এখন দেউলিয়া। যে ডিজিটাল ক্যামেরার উত্থানের জন্য ফিল্ম ক্যামেরার এই দুর্গতি, তার ভবিষ্যৎই এখন অনিশ্চিত মোবাইল ক্যামেরার জন্য। ফ্লপিডিস্ক এখন জাদুঘরে। পেনড্রাইভের ব্যবহারও এখন খুবই কম। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্ব যত লোক স্যানিটারি সুবিধা পায়, তার বেশি এখন মোবাইল ফোন আছে মানুষের হাতে। আজকের প্রযুক্তি কদিন পরেই সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রথাগত ব্যবসাই আমূল পাল্টে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। কী হবে তাহলে বছর কুড়ি পরে?

তখন রাজত্ব করবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ভার্চ্যুয়াল আর অগমেন্টেড রিয়েলিটি, রোবটিকস, ড্রোন, ব্লক চেইন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, ন্যানোটেকনোলজি কিংবা কম্পিউটারাইজড স্বাস্থ্যসেবা। আমরাও তাই প্রবেশ করে ফেলেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে। 

বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কারে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব, বিদ্যুতের উদ্ভাবনে হয়েছিল দ্বিতীয়টি আর কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রচলনে চলছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, বায়োটেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লবের কী কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রায়? 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই সবচেয়ে বড় প্রভাব বিস্তার করবে সামনের বছরগুলোতে। হয়তো সায়েন্স ফিকশনগুলো সত্যি হয়ে সুপার কম্পিউটারের মতন কোনো যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষকে। ইতিমধ্যেই গুগলের ‘আলফা-গো’ হারিয়েছে জটিল বোর্ড গেম ‘গো’-র সেরা খেলোয়াড়কে। আইবিএম ওয়াটসন এখন ৯০ শতাংশ নিখুঁতভাবে আইনি সেবা দিতে পারছে, যেখানে মানুষ সঠিকভাবে পারে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে। ফেসবুকের ‘প্যাটার্ন রিকগনিশন সফটওয়্যার’ মানুষের চেয়ে ভালোভাবে চেহারা চিনতে পারে। 

আইবিএম ওয়াটসন গত এক শ বছরের রোগীদের সব মেডিকেল হিস্ট্রি রেখে দিচ্ছে নিজের ডেটাবেইসে। কিছুদিন পর উপসর্গ বলে দিলে কম্পিউটারই ‘প্রিসিশন মেডিসিন’-এর মাধ্যমে সঠিকভাবে বলে দিতে পারবে আপনাকে কী কী স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে। ওয়াটসন এর মধ্যেই মানুষের চেয়ে ৪ গুণ নিখুঁতভাবে ক্যানসার নিরূপণ করতে পারে। কয়েক বছর পরেই কেবল মোবাইল ফোন দিয়ে রেটিনা স্ক্যান, ব্লাড স্যাম্পল কিংবা শ্বাসের মাধ্যমে ৫৪টি বায়োমার্কার বলে দেবে কোনো অসুস্থতায় ভুগছেন কি না আপনি। প্রতিবছর তাই মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৩ মাস করে।

১০০ ডলারের কৃষক রোবট বানানো হচ্ছে, যারা মাঠের কাজ সারবে। মানুষ কৃষকেরা কেবল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করবেন। কৃত্রিম আর্দ্র আবহাওয়ায় মাটির ব্যবহার ছাড়াই ‘অ্যারোপোনিক্স’ কৌশল দিয়ে ফলানো হচ্ছে নতুন ফসল। পানির ব্যবহার কমে যাবে এতে। পোকমাকড় দমন কিংবা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে স্বয়ংক্রিয় পরামর্শ দিচ্ছে বিভিন্ন স্মার্টফোন অ্যাপ। এই অ্যাপ দিয়ে গরু-মুরগি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাচ্ছে কি না বা কোনো অসুখ হয়েছে কি না, তা সেন্সর দিয়ে জেনে আপনাকে জানানোর ব্যবস্থা আছে এখন।

‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ বানানোর জন্য তোড়জোড় চলছে উন্নত বিশ্বে। পেপ্যাল, স্ট্রাইপ, গুগল ওয়ালেটের মাধ্যমে বিল-টিকিটসহ যেকোনো লেনদেন এখন করা যায় ব্যাংক বা কাউন্টারে না গিয়েই। অনুন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং ঘটিয়েছে আরেক বিপ্লব। বিটকয়েন কিংবা লিবরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে প্রথাগত কাগুজে নোটের বিকল্প রিজার্ভ হিসেবে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে আরও সহজ ও স্বচ্ছ। ফিন্যান্সিয়াল রোবো-অ্যাডভাইজর দিচ্ছে সঞ্চয়-বিনিয়োগের সঠিক পরামর্শ।

গুগল হোম, আমাজন অ্যালেক্সা দিয়ে একেকটি বাসা হয়ে যাচ্ছে ‘স্মার্ট হোম’। কেবল মুখের আওয়াজ দিয়ে বাসার বাইরে থাকলেও দরজার লক, লাইট-ফ্যান-টিভি, ঘরের তাপমাত্রা সবই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। ফ্রিজে পর্যাপ্ত বাজার না থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে অর্ডার চলে যাচ্ছে। ‘আমাজন গো’ নিয়ে এসেছে স্মার্ট সুপারশপ। কোনো বিক্রয়কর্মী থাকছেন না এতে, দাম পরিশোধের জন্য কোনো লাইনেও দাঁড়াতে হবে না আপনাকে। দোকানে গিয়ে কেবল প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে প্যাকেটে নিয়ে আসতে পারবেন বাসায়। 

চালকবিহীন গাড়ির জন্য বিপুল বিনিয়োগ করে যাচ্ছে গুগল, অডি, টয়োটা, মার্সিডিজ বেঞ্জ, নিশান, জেনারেল মোটরসের মতো বড় কোম্পানিগুলো। টেসলা নিয়ে আসছে ইলেকট্রিক গাড়ি। নিজস্ব গাড়ি না কিনেও উবার-লিফট-গ্র্যাবের বদৌলতে নিয়মিত গাড়িতে যাতায়াত করতে পারছেন আপনি। পার্কিং, আবর্জনা সংগ্রহ কিংবা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তি। যাতায়াতের সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সামনে থেকে আর শহরকেন্দ্রিক না–ও হতে পারে। শিল্পকারখানায় রোবটের ব্যবহারে উৎপাদন বাড়ছে কয়েক গুণ। ড্রোন দিয়ে ই-কমার্সে পণ্য ডেলিভারি শুরু করেছে আমাজন। 

মাত্র ১০ বছরের মধ্যে থ্রি-ডি প্রিন্টারের দাম ১৮ হাজার ডলার থেকে নেমে ৪০০ ডলারে নেমে এসেছে। সব বড় জুতা কোম্পানি ‘থ্রি-ডি প্রিন্টেড শু’ বের করেছে। চীনের সাংহাইয়ে এর মধ্যেই রিসাইকেলড কংক্রিট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ছয়তলা থ্রি-ডি প্রিন্টেড অফিস বিল্ডিং বানানো হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ, যা কিছু বানানো হবে, তার ৫ শতাংশই থ্রি-ডি প্রিন্টেড হবে। সার্জারির আগে ডাক্তাররা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের থ্রি-ডি মডেলের ওপর পরীক্ষা করে নিতে পারবেন। ইঞ্জিনিয়ার বা ডিজাইনাররা যেকোনো স্থানে বসেই কোনো পণ্যের থ্রি-ডি মডেল ফাইল পাঠাতে পারবেন অন্য কোনো অফিসে, যা সেখানে আসল পণ্য হয়ে বের হয়ে আসবে। 

অফিসের জন্য এত দিন ব্যবহার করে আসা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টের কাজ চলে আসছে ক্লাউড কম্পিউটিং ভিত্তিক ওয়েব সার্ভিস প্ল্যাটফর্মে। সহজে যেকোনো কারও সঙ্গে শেয়ার করার পাশাপাশি অফিসের বাইরেও যেকোনো জায়গা থেকেই একসেস করা যাচ্ছে এসব ভার্চ্যুয়াল ফাইল। পিসির হার্ডডিস্কের ওপরও চাপ কমে যাচ্ছে তাই।

ইউটিউব, স্পটিফাই, সাউন্ড ক্লাউডের এই যুগে শেষ কবে ডেস্কটপ-ল্যাপটপে রাখা গান শুনেছেন আপনি? টিভি-রেডিও চলে আসছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। নেটফ্লিক্সের জয়জয়কার এখন। ডিজনি, হুলু, আমাজন প্রাইম, অ্যাপল টিভি সবাই এখন অনলাইনে মুভি-সিরিজ-গান স্ট্রিমিং করার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রিন্ট পত্রিকার জায়গা করে নিচ্ছে অনলাইন পত্রিকা। প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের বদলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সবচেয়ে বড় আয় আসে এখন অনলাইন সাবস্ক্রিপশন থেকে। 

নিজস্ব কোনো কনটেন্ট না থাকার পরেও ফেসবুক এখন সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি। এ বছর বাংলাদেশে কোনো টিভি চ্যানেল লা লিগার ম্যাচ দেখাচ্ছে না; মেসি-হ্যাজার্ডদের দেখতে হবে ফেসবুকে স্ট্রিমিং করে। অনলাইনের জন্য আলাদা সম্প্রচার স্বত্ব বানাতে হচ্ছে প্রযোজক আর আয়োজকদের। ১০ কোটি লোকের কাছে টেলিফোন ব্যবস্থা যেতে সময় লেগেছিল ৭৫ বছর, পোকেমন গো এক মাসেই সমান লোকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে ২০১৬ সালে। অচিরেই ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে অ্যাডভারটাইজিং আর এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিকে।

সামনে অসাধারণ এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। অভাবনীয় গতিতে প্রথাগত অনেক ব্যবস্থা ভাঙচুর করে নিজস্ব পথ করে নিচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। ডেল জানাচ্ছে, ২০৩০ সালে এমন সব চাকরি থাকবে, যার ৮৫ ভাগেরই অস্তিত্ব নেই এখন। অনেকে চাকরি হারাবেন অটোমেশনের কারণে, আবার নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হবে। ২০৪০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী একদল প্রজন্ম থাকবে, যারা ‘টেকনোলজিক্যাল সাউন্ড’। এদের জন্য হয়তো গড়ে উঠবে নতুন কোনো সার্ভিস, এখন যা কল্পনাতেও আনতে পারছি না আমরা। 

আপনি বা আপনার প্রতিষ্ঠান তৈরি তো? 

প্রিয়ম মজুমদার: সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্যাভিলিয়ন