আলো ছড়ানো তারা

শুরুর গল্পটা ব্যাংকার হিসেবে একজন নারীর সফলতা নিয়ে। মাহতাব জাবিন পেশায় ব্যাংকার। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। এরপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে পেশাগত উৎকর্ষ ছড়িয়ে এখন নিজ পেশায় শীর্ষ পদে উঠে এসেছেন। একটি ব্যাংক চালান তিনি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন মাহতাব জাবিন। নিজেকে আরও প্রস্তুত করার জন্য ২০০৪ সালে বেলজিয়াম থেকে মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) ডিগ্রি নেন। যা তাঁকে উচ্চ পদে যেতে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। 

বাংলাদেশের করপোরেট জগতে শীর্ষ পদে যেতে নারীর সুযোগ বাড়ছে বলে মনে করেন মাহতাব জাবিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ দেশে নারীদের সংসার ও চাকরি দুটোই সামলাতে হয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হয়। এটি এ দেশের চাকরিজীবী নারীর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। 

ফারাহ কবির একজন উন্নয়নকর্মী। এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিচালনায় একটি বিশাল দলকে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

ফারাহ কবির পেশাগত জীবন শুরু করেন ১৯৯০ সালে। পেশাজীবনের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস), ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের যুক্তরাজ্য কার্যালয়েও পাঁচ বছর কাজ করেছেন। এভাবেই নিজেকে যেমন প্রস্তুত করেছেন, বাড়িয়েছেন নিজের দক্ষতা। যা নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করেছে। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্য থেকেই একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টরের চাকরি নিয়ে দেশে ফেরেন।

ফারাহ কবির প্রথম আলোকে বলেন, ৪০ বছর ধরে ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে এগিয়ে আসছেন নারীরা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে কঠোর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা দিয়ে তাঁরা এসব উচ্চ পদে আসছেন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ আরও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। 

গবেষণার ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অন্যতম বড় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক একজন নারী। আড়াই বছর ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ফাহমিদা খাতুন। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফাহমিদা খাতুন ১৯৮৯ সালে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। পরে দেশে ফিরে সিপিডিতে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা পরিচালক পদে পদোন্নতি পান। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ মার্চে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক হন। 

ফাহমিদা খাতুনের মতে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুলসংখ্যক মেয়ে পাস করেন। তাঁদের বেশির ভাগই পেশাজীবনেও প্রবেশ করেন। যখন তাঁরা ক্যারিয়ারের মধ্যম পর্যায়ে যান, তখন সন্তান জন্মদানসহ নানা ধরনের সাংসারিক চাপে চাকরি ছেড়ে দেন। কর্মবিরতির পর যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর চাকরিতে যেতে পারেন না। এভাবেই সম্ভাবনার অপচয় হচ্ছে। 

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প আরও পথ পাড়ি দিচ্ছে। করপোরেট জগৎসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহীসহ উচ্চ পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রতিবছরই এই নারী ‘বস’ বাড়ছে। নারীরা এখন ব্যাংক, বিমা, কলকারখানার পাশাপাশি সেবা খাতের বিভিন্ন কোম্পানি চালাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ২০১৭ সাল নাগাদ এ দেশে শিল্প ও সেবা খাতে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এবং এ ধরনের উচ্চ পদে ১৪ হাজার নারী কাজ করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। তাঁরা সবাই মূলত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বার্জারের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একজন নারী। এক দশকের বেশি সময় ধরে বার্জার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী। সাধারণ কর্মী থেকে শীর্ষ পদে যাওয়ার উদাহরণ এখন তিনি। 

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, উচ্চ পদে থাকা নারীদের মধ্যে ১১ হাজার সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বাকি ৩ হাজার নারী শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। 

আগের চার বছরের ব্যবধানে করপোরেট জগতের উচ্চ পদে গেছেন এমন নারীর সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এই সময়ে উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ২০১৩ সালের বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা নীতি নির্ধারণী উচ্চ পদে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ জন নারী ছিলেন।