নগদ সহায়তা কমানোয় সংকটে পড়বে হস্তশিল্প

গোলাম আহসান, সভাপতি, বাংলাদেশ হস্তশিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি
গোলাম আহসান, সভাপতি, বাংলাদেশ হস্তশিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি
>

সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হস্তশিল্প রপ্তানিতে বেশি দূর এগোতে পারেনি বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর খাতটিতে নগদ সহায়তা অর্ধেক কমিয়ে দেওয়ায় নতুন করে সংকট তৈরির শঙ্কার কথা জানান উদ্যোক্তারা। হস্তশিল্প খাতের বর্তমান সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ হস্তশিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি বা বাংলাক্রাফটের নবনির্বাচিত সভাপতি গোলাম আহসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: হস্তশিল্প খাত কেমন চলছে? রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

গোলাম আহসান: ভালো–মন্দ মিলিয়ে আছে হস্তশিল্প খাত। পণ্য উৎপাদনের খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কাঁচামালের দাম, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সে জন্য ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অনেক উদ্যোক্তার জন্যই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছর আবার হোগলা, খড়, ছন, নারকেলের ছোবড়া, বাঁশ-বেত ইত্যাদি দিয়ে হস্তশিল্প রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা ধরেই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আমরা পণ্যের দাম অফার করতাম। হঠাৎ করে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে নতুন করে সংকটে পড়বে হস্তশিল্প খাত। হস্তশিল্প খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা বহাল রাখতে হবে। সে জন্য আমরা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তবে মূল কাজটি অর্থ মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে।

প্রথম আলো: নগদ সহায়তা পাওয়ার পরও ছয়-সাত বছর ধরে আমরা দেখছি, হস্তশিল্পের রপ্তানি ১ থেকে ২ কোটি ডলারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে নগদ সহায়তা দিয়ে লাভ কী?

গোলাম আহসান: বিদায়ী অর্থবছর মাত্র ১ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের হস্তশিল্প রপ্তানি দেখিয়েছে ইপিবি। সেখানে পাট ও চামড়া দিয়ে তৈরি বৈচিত্র্যময় হস্তশিল্প হিসাব করা হয়নি। সেসব হিসাব করলে হস্তশিল্পের রপ্তানি পাঁচ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তার মানে রপ্তানি যে একেবারেই কম সেটি বলা যাবে না। রপ্তানি হওয়া হস্তশিল্প তৈরি করেন গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা। নগদ সহায়তা না পেলে বাজার হারাবে আমাদের পণ্য। তাতে প্রান্তিক নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই খাতটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে নগদ সহায়তা দিয়ে যেতে হবে।

প্রথম আলো: হস্তশিল্পের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই আমদানি করে ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের হস্তশিল্প। ফলে হস্তশিল্পের যে সম্ভাবনা আছে, সেটি পরিষ্কার। তো হস্তশিল্পের রপ্তানি বাড়াতে হলে কী করতে হবে মনে করেন আপনি?

গোলাম আহসান: রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে না, কারণ আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য নেই। নতুন নতুন নকশার পণ্য উৎপাদনের জন্য কোনো ডিজাইন সেন্টার নেই। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একটি ডিজাইন সেন্টারের কথা বলছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তা ছাড়া কাঁচামালের স্বল্পতা তো পুরোনো সমস্যা। অতিবৃষ্টির কারণে হোগলা, ছন ইত্যাদির উৎপাদন কম হয়েছে। সে জন্য দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ভিয়েতনামে হস্তশিল্পের কাঁচামাল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। বাংলাদেশেও সেটি করা সম্ভব। কারণ, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক পতিত জমি আছে। আমাদের কৃষি অধিদপ্তর চাইলেই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ছন, হোগলা ইত্যাদি চাষ করতে পারে। তা ছাড়া দক্ষ জনবল তৈরির জন্য একটি ইনস্টিটিউট ও পণ্য রাখার জন্য বড় আকারের গুদাম বা ওয়্যারহাউস দরকার। আমাদের উদ্যোক্তারা এত ছোট যে তাদের পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়। তাই সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সরকার যদি একটি রূপকল্প তৈরি করে, সে অনুযায়ী ডিজাইন সেন্টার, কাঁচামালের বাণিজ্যিক চাষ, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং ওয়্যারহাউস করে দেয়, তাহলে হস্তশিল্প প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে উঠে আসতে পারে। ভিয়েতনাম পরিকল্পনামাফিক কাজ করে দুই দশকের মধ্যে হস্তশিল্প রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারে নিয়ে গেছে। তাহলে আমরা কেন পারব না?

প্রথম আলো: বর্তমানে দেশে ব্যবসার পরিবেশ কেমন?

গোলাম আহসান: হস্তশিল্প রপ্তানিকারকদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই)। কিন্তু দু-চারজন ছাড়া কেউ এসএমই ঋণ পাচ্ছে না। কারণ, জটিলতা অনেক বেশি। বেসরকারি ব্যাংকেও আজকাল ত্রাহি অবস্থা। কোনো ব্যাংক পয়সা দেয় না। বলছে, ফান্ডে টাকা নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমন জামানত চাইছে, যা কি না অবাস্তব। এদিকে কয়েক বছরের ব্যবধানে মফস্বলে চাঁদাবাজি ও মাস্তানি বেশ বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা যাঁরা প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করি, তাঁরা খুব মুশকিলের মধ্যে আছি। এসব বন্ধ করার জন্য শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।