বাফেটের এক ফোনেই যা হলো

ওয়ারেন বাফেট। ছবি: রয়টার্স
ওয়ারেন বাফেট। ছবি: রয়টার্স

২০০৮ সালের অক্টোবর। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। চলছে মন্দা। কীভাবে অর্থনীতির হাল ধরা যায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হর্তাকর্তারা। এমন এক দিনে গভীর রাতে একটি ফোন পান তৎকালীন মার্কিন অর্থমন্ত্রী হেনরি পলসন।

অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছিলেন তিনি। আর্থিক মন্দায় বিপর্যস্ত ওয়াল স্ট্রিট। বড় দরপতন হচ্ছে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কী করবেন, তা নিয়ে নানা নীতি পর্যালোচনা করেছেন। সেই সময় কংগ্রেস সবেমাত্র ‘জরুরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আইন’ পাস করেছে। সেটাকে অর্থ সহায়তা বিলও বলা যেতে পারে। ঋণে ডুবে যেতে থাকা ব্যাকগুলোর সম্পত্তি কিনে নেওয়ার জন্য ৭০০ বিলিয়ন ডলারের ‘ট্রাবলড অ্যাসেট রিলিফ প্রোগ্রাম (টিএআরপি)’ গঠন করা হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপ যথেষ্ট ছিল না। কারণ, ইতিমধ্যে বৃহত্তম দুটি ব্যাংক ওয়াকোভিয়া ও ওয়াশিংটন মিউচুয়াল দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ‘আমাদের এমন কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল যা আরও দ্রুত কাজ করবে, এসব নিয়ে আমি বিপর্যস্ত ছিলাম’-২০০৮ সালের মার্কিন অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে করা এক তথ্যচিত্রে এই কথা বলেন পলসন। তিনি জানান, একসময় দুশ্চিন্তা নিয়েই ঘুমিয়ে যান। তবে ফোনটা এসেছিল বেশ রাত করে।

‘এ সময় তো কোনো ফোন আসার কথা নেই। কে হতে পারে? ওয়ারেন ফোন করেছে? ওয়ারেন তো মায়ের সহকারী, সে কেন এত রাতে ফোন দিল’—প্রথমে এমনটাই মাথায় এসেছিল পলসনের। একটু পরেই রাশভারী কণ্ঠটা শুনে বুঝতে পারেন ফোন করেছেন বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ওয়ারেন বাফেট। বাফেট তখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী।

পলসনকে একটি পরামর্শ দিলেন বাফেট। তিনি বলেন, এই সব দেউলিয়া হতে বসা ব্যাংকগুলোর সম্পত্তি না কিনে বরং ব্যাংকগুলোতে আরও বেশি মূলধন জোগান দিলে তা বেশি অর্থবহ হবে।

পরে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর বড় বড় ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে (যাঁদের মধ্যে ছিলেন মরগ্যান স্ট্যানলির জন ম্যাক, জে পি মরগ্যানের জেমি ডিমন, গোল্ডম্যান স্যাকসের লয়েড ব্ল্যাংকফেইন, মেরিল লিঞ্চের জন থায়েন, সিটি গ্রুপের বিক্রম পণ্ডিতসহ আরও অনেকে) বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে অনেকে প্রস্তাবটা বেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।

অবশ্য সব ব্যাংকের সে সময় সহায়তার প্রয়োজন ছিল না। অনেক প্রধান নির্বাহী সহায়তা নিতে অস্বীকারও করেন। তাঁদের মনে একটা ভয় ছিল হয়তো এই খবরে জনগণ মনে করবেন তাঁরা বিপদে আছেন। বিনিয়োগকারীরা সরে যাবেন। তবে পলসন জোর দিয়েছিলেন যে অর্থনীতির প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য এই অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। পরে বৈঠকে মোটামুটি সবাই এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। বৈঠকের শেষে সিদ্ধান্ত হয় অর্থ মন্ত্রণালয় টিএআরপি তহবিল থেকে ব্যাংক ব্যবস্থায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে।

 অবশ্য এই পরিকল্পনাটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় অবস্থান নেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, করদাতাদের অর্থ নিয়ে ওয়ালস্ট্রিটের ধনীদের সহায়তা করা হচ্ছে। তাঁরা স্লোগান দেন, ‘গরিবের জন্য অর্থ সহায়তা, ধনীর জন্য নয়’। পরিস্থিতি প্রথমে কিছুটা নাজুকই হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে সর্বোচ্চ দরপতন হয় মার্কিন পুঁজিবাজারে।

ওই আন্দোলনের বিষয়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বেন বার্নকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক মানুষ বিশ্বাস করতেন আমরা কোম্পানিগুলোকে যে অর্থ সহায়তা দিচ্ছি তা অনেকটা বন্ধুত্বের খাতিরে। আমরা কেবল আর্থিক খাতের বন্ধুদের সহায়তা করছি। মার্কিন অর্থনীতি রক্ষায় আমাদের আগ্রহ নেই।

পলসন, বার্নকে ও নিউইয়র্ক ফেড প্রেসিডেন্ট টিমোথি গেইথনার ওই অর্থ সহায়তার বিষয়ে বলেন, ওই অর্থ সহায়তা মূলত ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করেছিল। যদিও এই তিন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে তাঁরা এই সংকট মোকাবিলায় একেবারে নিখুঁত কাজ করতে পারেননি। যেমন তাঁরা লেহম্যান ব্রাদার্সকে ধসের হাত থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

২০০৯ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। ব্যাংকগুলোও বিপদ কাটিয়ে উঠতে থাকে। ওই অর্থ সহায়তার কারণেই যা হয়েছিল। বলা যেতে পারে একটি ফোন করেই পাল্টে দিয়েছিল মার্কিন অর্থনীতি।

২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকে বলা হয় ১৯২৯ সালের মহামন্দার পর সবচেয়ে বড় আর্থিক মন্দা। এর প্রধান কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেশটির বন্ধকি বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের শিথিল নিয়ন্ত্রণই মন্দার শুরুটা করেছিল। ব্যাংকগুলো খুব দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় গ্রাহকদের সহজ শর্তে বাড়ির ঋণ দিচ্ছিল। বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যখন এই আবাসন খাতের বুদ্‌বুদ ছাপিয়ে পড়ল, তখন বাড়ির দামও কমে গেল। ওই সময় বাড়ির দাম ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যায়। আর বন্ধকি ঋণের সুদের হারও রাতারাতি বেড়ে গেল। একেকজনের ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা বেড়ে গেল বহু গুণ। অনেকেই ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে দেউলিয়া হয়ে পড়ছিল ব্যাংকগুলো।