৫ মিনিটেই খুলবে ব্যাংক হিসাব

৩৫ বছর বয়সী মায়া বেগম ব্যাংক হিসাবের কিছুই বোঝেন না। থাকেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জ ইউনিয়নে। গত মাসে তিনি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে একটি হিসাব খুলেছেন। এ জন্য তাঁর কোনো কাগজপত্র লাগেনি। পুরো বিষয়টি অবাকই লেগেছে প্রত্যন্ত গ্রামের লেখাপড়া না জানা এই হতদরিদ্র নারীর।

মায়া বেগম আমিরগঞ্জ ইউনিয়নে ওই ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্রে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিয়েছিলেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে তাঁর পরিচিতি-তথ্য চলে আসে এজেন্টের কাছে। মাত্র পাঁচ মিনিটেই খুলে গেছে তাঁর ব্যাংক হিসাব।

মায়া বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘ব্যাংক হিসাবের কিছুই বুঝি না। সরকারি ভাতা নিতে ব্যাংক হিসাব লাগবে। এজেন্টের কাছে গেছি। আঙুলের ছাপ দিছি। হিসাব নাকি খুইলা গেছে।’

বর্তমানে ব্যাংক হিসাব খুলতে বাধ্যতামূলক নো ইওর কাস্টমার (কেওয়াইসি) ফরম পূরণ বা গ্রাহককে বিস্তারিত তথ্য জমা দিতে হয়। ব্যাংকভেদে এই ফরমে ৫০ থেকে ৭০টি প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। এতে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে কয়েক দিন পর চালু হয় হিসাব। এবার সেই পরিস্থিতির অবসান হতে যাচ্ছে।

৫ মিনিটে ব্যাংক হিসাব খোলেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার রানু রানী মদদ। সম্প্রতি ই-কেওয়াইসি চালুর পাইলট প্রকল্পের সময় পাটুলি ইউনিয়ন কেন্দ্রে তোলা।  ছবি: এনআরবিসি
৫ মিনিটে ব্যাংক হিসাব খোলেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার রানু রানী মদদ। সম্প্রতি ই-কেওয়াইসি চালুর পাইলট প্রকল্পের সময় পাটুলি ইউনিয়ন কেন্দ্রে তোলা। ছবি: এনআরবিসি

আগামী জানুয়ারিতে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি বা ই-কেওয়াইসি চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের শাখা, এজেন্ট ও বুথগুলোতে হিসাব খুলতে এই সুবিধা পাবে। এরই মধ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ৩৩ জেলার ৫০ এলাকায় ব্যাংক হিসাব খুলতে ই-কেওয়াইসি ব্যবহৃত হয়েছে। এতেই এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন নরসিংদীর মায়া বেগম।

ব্যাংকটির আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের এজেন্ট নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাইলট প্রকল্প হিসেবে আমরা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ্য (কেওয়াইসি) সংগ্রহ করেছি। এর মাধ্যমে পাঁচ মিনিটেই হিসাব খুলছে।’

জানা যায়, বর্তমানে ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে চালু আছে ডিজিটাল এ সেবা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কেওয়াইসি বিষয়ে কমিটি গঠন করে। মূলত সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির ভাতা প্রদানের জন্য হিসাব খুলতে ই-কেওয়াইসির বিষয়টি সামনে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন এ সেবার ফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সহজেই ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। ধাপে ধাপে এই সেবা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

>

বর্তমানে ব্যাংক হিসাবের ফরম পূরণ করতে লাগে ৩০ মিনিট
আর হিসাব চালু হতে লেগে যায় কয়েক দিন
জানুয়ারিতে ই-কেওয়াইসি চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
ই-কেওয়াইসি চালু হলে ব্যাংক হিসাব খোলা সহজ হয়ে যাবে

বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির ভাতা এখন ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। আগে থেকে এ কর্মসূচির সুবিধাভোগী ছিল প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ। এবার তা বেড়ে হবে ৮৯ লাখ।

যেভাবে চলবে ই-কেওয়াইসি
মূলত চারটি ধাপে সম্পন্ন হবে পুরো ই-কেওয়াইসি প্রক্রিয়া। প্রথমে হিসাব খুলতে আসা ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ বায়োমেট্রিকের (আঙুলের ছাপ, মুখমণ্ডলের ছবি বা আইরিশ) মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। এ প্রক্রিয়া কোনো ব্যাংকের শাখায় বা এজেন্টদের কাছে থাকা ট্যাবে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। তখন নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে তাৎক্ষণিক যাচাই হবে গ্রাহকের পরিচিতি।

পরিচয় নিশ্চিত হলে গ্রাহকের নাম, মা-বাবার নাম, লিঙ্গ, পেশা, মোবাইল ফোন নম্বর, ঠিকানা, মনোনীত ব্যক্তির (নমিনি) পরিচয় উল্লেখ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেওয়াইসি ফরমে চলে আসবে। পরে গ্রাহকের ছবি তোলা হবে। এরপর হিসাব খোলার বিষয়ে গ্রাহককে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠাবে ব্যাংক। গ্রাহক বার্তা পাওয়া মানেই হিসাব খোলা সম্পন্ন। কাগজপত্র ছাড়াই পুরো কাজটি হবে অনলাইনে।

যেসব সেবা পাওয়া যাবে
ই-কেওয়াইসি দিয়ে হিসাব খোলা হলেও প্রথম পর্যায়ে বড় অঙ্কের লেনদেন করা যাবে না। বড় অঙ্কের লেনদেন করতে প্রচলিত নিয়মে কেওয়াইসি ফরম পূরণ করতে হবে। ই-কেওয়াইসি দিয়ে মোবাইলে আর্থিক সেবা তথা বিকাশ, রকেট সেবা নেওয়া যাবে। এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবে বছরে সর্বোচ্চ লেনদেন হবে এক লাখ টাকা। ঋণ নেওয়া যাবে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা জমা রাখা যাবে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য সরকারি বন্ডে বিনিয়োগও করা যাবে।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ই-কেওয়াইসির বিকল্প নেই। কারণ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষে এত বড় কেওয়াইসি ফরম পূরণ করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে ই-কেওয়াইসির পরিধি বাড়াতে হবে।


খোলা হয়েছে ১ হাজার ৭৫০টি হিসাব
গত সেপ্টেম্বরে ১৬টি ব্যাংক, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিকাশ ও রকেট মিলে ১ হাজার ৭৫০টি ব্যাংক হিসাব ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে খুলেছে। এতে দেখা যায়, প্রতিটি ই-কেওয়াইসি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে পাঁচ মিনিট। মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে এসব হিসাব খোলে ব্যাংকগুলো।

হিসাব খোলা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, ব্যাংক এশিয়া, এনআরবি কমার্শিয়াল, ইসলামী, মার্কেন্টাইল, ট্রাস্ট, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ওয়ান, ব্র্যাক, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউসিবিএল, দি সিটি, আইএফআইসি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি।

সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন প্রথম আলাকে বলেন, ‘আমরা পাইলট ভিত্তিতে ১০০ হিসাব খুলেছি। আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে হিসাব খোলা যাচ্ছে। গণমানুষকে ব্যাংকিং সেবায় আনতে এর বিকল্প নেই।’

এরই মধ্যে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদ ই-কেওয়াইসি সুবিধা চালু করেছে। বিকাশের করপোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম প্রথম আলোকে বলেন, আগে হিসাব খুলতে সাত দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেত। সব ফরম প্রধান কার্যালয়ে আসত, যাচাই-বাছাই শেষে হিসাব খোলা হতো। এখন কয়েক মিনিটেই খুলে যাচ্ছে। বিকাশে হিসাব খুলতে কাউকে এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। নিজেই নিজের হিসাব খুলতে পারছেন।

কমবে অবৈধ লেনদেন
সারা বিশ্বে কতসংখ্যক মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আছে, তা নিয়ে গত বছর গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচক-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক ৩০ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব ছিল। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪০ শতাংশ। তবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কারণে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে।

ই-কেওয়াইসি চালু হলে আরও বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এতে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে আসবে। ফলে টাকার অবৈধ ব্যবহারও কমবে। কারণ, অবৈধ লেনদেনের বড় অংশই নগদে হয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব টাকা এলে বাড়বে অর্থনীতির গতিও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, যত বেশি মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যাবে, দেশের অর্থনীতির জন্য তত ভালো হবে। এতে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন কমে আসবে। অর্থের অবৈধ ব্যবহারও কমবে।