'দিনে এখন একটি পেঁয়াজ'

পেঁয়াজ। ফাইল ছবি
পেঁয়াজ। ফাইল ছবি

জরিনা বেগম গত সোমবার দুটি পেঁয়াজ কিনেছেন ২০ টাকা দিয়ে। একটি দিয়ে সেদিনের রান্না হয়েছে, আরেকটির অর্ধেক দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ডাল রান্না আর আলুভর্তা বানিয়েছেন তিনি। বাকি অর্ধেকে হবে রাতের রান্না।

ঢাকার মিরপুরের ভাষানটেক বস্তির ৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা জরিনা বেগম পিঠা বিক্রি করে সংসার চালান। দিনে শ চারেক টাকা আসে, যা দিয়ে তাঁর পাঁচজনের সংসার চলে। মাসে দুই হাজার টাকা ঘর ভাড়ার বাইরে খাওয়ার খরচই বেশি, সামান্য মূল্যবৃদ্ধিতেই সংসারে চাপ তৈরি হয়। এই অবস্থায় এখন একটি পেঁয়াজেই দিন পার করতে হচ্ছে।

ঢাকার খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম উঠেছে প্রতি কেজি ১৫০-১৬০ টাকা। আর অন্যান্য দেশের পেঁয়াজ ১৪০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। এ দর স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এ ছাড়া কিছুদিনের মধ্যে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা, সয়াবিন তেল লিটারে ২ থেকে ৪ টাকা, পাম তেল লিটারে ২ টাকা ও আলু কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। কিছুটা বাড়তি আটার দামও। বাজেটে কর বাড়ানোর পরে চিনি ৬০ টাকা কেজির নিচে নামছে না। নতুন করে রসুনের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১৫০-১৬০ টাকায় উঠেছে। শীতের নতুন সবজি এসেছে, দাম কম নয়। অবশ্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে পেঁয়াজ।

গরিবেরা এত দামের পেঁয়াজ কীভাবে কিনছেন, সেই খোঁজে গিয়েছিলাম ভাষানটেক বস্তিতে। বস্তির ১ নম্বর রোড (আসলে গলি) দিয়ে কয়েক শ গজ এগিয়ে গেলে চম্পা বেগমের দোকান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি চা, পুরি ও শিঙাড়া বিক্রি হয় সেই দোকানে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পৌঁছে দেখা গেল, চম্পা বেগম চুলায় ব্রয়লার মুরগি চড়িয়েছেন। পাশেই একটি বস্তায় কিছু দাগ পড়া পেঁয়াজ। কেজি ১৫০ টাকা।

বস্তির মানুষেরা পেঁয়াজ কেমন কেনে? চম্পা বেগমের উত্তর, যারা এক কেজি কিনত, তারা এখন ২০ টাকার কেনে। বস্তিবাসীরা রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। কীভাবে, সেটাও জানালেন তিনি। বললেন, ‘ডাল বাগার দিতে এখন অনেকে শুধু রসুনই দেয়। যারা আগে এক তরকারিতে তিন-চারটি পেঁয়াজ দিত, তারা দেয় একটি।’

>

স্মরণকালের মধ্যে দেশে সবচেয়ে চড়া দাম পেঁয়াজের। চাল, ভোজ্যতেল ও আলুর দাম বাড়ায় চাপে সীমিত আয়ের মানুষ।

ভাষানটেক বস্তি থেকে মিরপুর ১৪ নম্বর চত্বরের দিকে আসতে হাতের বাঁ দিকে মঞ্জু মার্কেট। এর সামনে ভ্যানগাড়িতে বসে অস্থায়ী বাজার। সেই বাজার থেকে কেনাকাটা করে ফিরছিলেন শিউলি আক্তার, হাতে একটি পলিথিনে তিনটি দেশি পেঁয়াজ। তিনি জানালেন, ছোট আকারের পেঁয়াজ তিনটির দাম পড়েছে ১৫ টাকা। লজ্জিত শিউলি বললেন, দুটি-তিনটি করে পেঁয়াজ কখনো কিনতে হয়নি।

শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নয়, মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেও চাপ তৈরি করেছে পেঁয়াজ। বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলামের সংসারে মাসে পাঁচ কেজির মতো পেঁয়াজ লাগে। তিনি বলেন, আগে ২০০ টাকার মধ্যেই মাস চলে যেত। এখন পরিমাণে এক কেজি কমিয়ে দিয়েও খরচ ৬০০ টাকা দাঁড়াবে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত বছর এ সময়ে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকার মধ্যে ছিল। এখন ১২৫ থেকে ১৪৫ টাকা। যদিও কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানেই গতকাল বিকেলে দেশি পেঁয়াজ ১৫০ টাকা এবং মিসর, তুরস্ক, চীনসহ কয়েকটি দেশের নানা রং ও আকারের পেঁয়াজ ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়।

পেঁয়াজের এই সংকট শুরু হয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর। দুই সপ্তাহ আগেই অবশ্য দেশটি ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। ভারতীয় পেঁয়াজ বন্ধের পর দেড় মাস হতে চলল, ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে আছেন, কবে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর আমদানি করা পেঁয়াজ দেশে পৌঁছায়। অবশ্য তা-ও দু-চার দিনে আসছে না। সব মিলিয়ে মানুষকে ভুগতে হতে পারে আরও সপ্তাহ দুয়েক।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান একসময় বাণিজ্যসচিব ছিলেন। এরপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চেয়ারম্যান পদে চাকরি করেছেন। তিনি দু-একবার পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছাড়াতে দেখেছেন, ১৫০ টাকা নয়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সীমিত আয়ের মানুষের মোট আয়ের ৪০ শতাংশ যায় বাড়িভাড়ায়। বাকি টাকার ৮০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে তারা। দাম বেড়ে গেলে ধার-কর্জ, সঞ্চয় কমানো অথবা বাজার করা কমানো ছাড়া উপায় থাকে না। তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির মূল শিকার গরিব মানুষ।