আহা! পেঁয়াজ!

পেঁয়াজের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে পেঁয়াজ কাটলে তবেই চোখ থেকে পানি পড়ত, এখন দেখলেই পানি পড়ে। তবে এ জন্য অবশ্য বাজারে যেতে হবে। আসলে পেঁয়াজ নিজেই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থশাস্ত্রে নিত্য পণ্য ও বিলাসী পণ্যের পার্থক্য, চাহিদা আর দামের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কিছু বলা আছে। আবার গল্পে যে দেশে তেলের দাম আর ঘিয়ের দাম এক, সেই দেশে বসবাস না করার পরামর্শ দেওয়া আছে। দেশে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চেয়ে আপেলের দাম বেশি, এমনকি এক কেজি পেঁয়াজের দামে পাওয়া যায় দুই লিটারের বেশি অকটেন।

বলিউডের নায়িকার সঙ্গে একসময় সম্পর্ক ছিল রণবীর কাপুরের। ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রেমিকাকে নিয়ে রণবীর কাপুর বলেছিলেন, ‌‘সে পেঁয়াজের মতো—একটার পর একটা স্তর (লেয়ার), স্তরের পর স্তর…ক্যাটরিনা সম্পর্কে আজও পাঁচ ভাগ জানা হয়নি।’ সুতরাং প্রেমিকা অন্বেষণেও পেঁয়াজের গুরুত্ব মোটেই কম নয়।

পেঁয়াজের গুরুত্ব আছে নানাভাবেই। এর পুষ্টিগুণ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, উপগ্রহ বিশেষজ্ঞ ম্যাগি অ্যাডরিন-পোকক সম্প্রতি শুনিয়েছেন ভিন্ন এক কথা। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ভিনগ্রহের ‘মানুষ’ দেখতে হবে ‘জেলিফিশ’–এর মতো, দেখতে আকৃতিতে ছোট, সবুজ এবং নিচের দিকটা হবে কমলা রঙের। তাদের দেহ হবে পেঁয়াজ আকৃতির এবং অনেকটা গরম বাষ্পপূর্ণ বেলুনের মতো কাজ করবে, প্রয়োজনে তা গ্যাস টেনে নেবে বা ছেড়ে দেবে। ফলে সহজেই উঁচুতে উঠতে বা নিচে নামতে পারবে। সুতরাং পেঁয়াজ মোটেই হেলাফেলার কোনো বিষয় নয়।

গুগল ঘেঁটে পেঁয়াজ নিয়ে তৌফিকুর রহমানের একটি লেখা পাওয়া গেল। তিনি লিখেছেন, প্রাচীন রোমের এক বিখ্যাত খাদ্যরসিক ছিলেন এপিসিয়াস। তাঁর লেখাতে পেঁয়াজের উল্লেখ ছিল। প্রাচীন মিসরের বিখ্যাত পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নার মেন্যুতেও ছিল পেঁয়াজ। গবেষকেরা বলেন, মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানব বসতিতে সবজি হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। অনেক অঞ্চলে পেঁয়াজকে অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি ও এর সমকেন্দ্রিক একটির ওপর আরেকটি চক্রাকার রিং থেকে এই ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়।

প্রাচীন মিসরীয়রা মনে করত মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখত। রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায় রাজার মমির দুই চক্ষুকোটরে ভরে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ। এ ছাড়া মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি স্থানে পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিসরীয় পিরামিডের ভেতরের নানা চিত্রকর্মে পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদেরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতেন। এ ছাড়া নিজেদের পেশি আরও মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাঁদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতেন। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্ন্যুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। আবার ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পেঁয়াজের ব্যবহারের কথা জানা যায়।

সব মিলিয়ে পেঁয়াজ মোটেই হেলাফেলার বিষয় নয়। এর একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও আছে। পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় উঠেছিল বলে ১৯৯৮ সালে দিল্লির সুষমা স্বরাজের সরকারের পতন ঘটেছিল। এরপর ক্ষমতায় এসে কংগ্রেসের শিলা দীক্ষিতের সরকার টিকে ছিল ১৫ বছর। সেই পেঁয়াজ এখন ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য পেঁয়াজ ভারতে রাজনৈতিকভাবে যতটা স্পর্শকাতর পণ্য, বাংলাদেশে তা নয়। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। তবে একই সঙ্গে মানুষ এ নিয়ে মজা করতেও ভুলছে না। এ–ও যেন ক্ষোভের একধরনের প্রকাশ। একই ধরনের মজার মজার গল্প-কৌতুক তৈরি হচ্ছে ভারতেও। একসময় মুখের পেঁয়াজের গন্ধ দূর করতে কত কিছুই ব্যবহার করতে হতো, আর এখন মুখে পেঁয়াজের গন্ধ মানেই ছেলে ধনী। টুইটার, ফেসবুকে এ রকম গল্প এখন ছড়িয়ে পড়েছে।

পেঁয়াজ স্থান পেয়েছে কমিক বইতেও। জ্যাক থমসনের লেখা কমিক বইটি হচ্ছে দ্য বুক অব অনিয়ন। বইটির প্রচ্ছদে লেখা আছে, ‘এমন এক বই যা পড়ে আপনি কাঁদবেন, হাসবেন, আবার কাঁদবেন।’

তবে পেঁয়াজ নিয়ে সাম্প্রতিক সেরা কৌতুকটি বলেছেন আমাদের শিল্পমন্ত্রী। জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর হয়ে তিনি জানিয়েছেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। ওই দিন দেশের বাজারে পেঁয়াজের দর ছিল কেজিপ্রতি ১৮০ টাকা। ব্যবসায়ীরা শিল্পমন্ত্রীর কথা শোনার পরপরই ২০ টাকা দাম বাড়িয়ে ২০০ টাকা করে দেন। আর এখন পেঁয়াজের দাম তো আরও বেশি, দ্বিশতক ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় থামবে কেউ জানেন না।