রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যের ধারেকাছে নেই

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন করার সময় বলা হয়েছিল, এটির বাস্তবায়ন শুরু হলে রাজস্ব আদায় বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। অথচ বাস্তবায়ন শুরুর প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভ্যাট আদায় বাড়েনি, বরং কমে গেছে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভ্যাট আদায় বাড়াতে পারেনি।

একক হারের পরিবর্তে একাধিক ভ্যাট হার করে গত জুলাইয়ে নতুন আইনটি চালু হয়। 

মোট রাজস্বের তিন ভাগের এক ভাগের মতো আসে আমদানি খাত থেকে। সেখানকার খবরও ভালো নয়। মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। ফলে আমদানি পর্যায়েও রাজস্ব আদায় আগের চেয়ে কমেছে। আবার দেশের রপ্তানিও কমেছে। 

সার্বিকভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় যেন আটকে গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আদায়ের সাময়িক হিসাবে ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলোর প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে। এ বছর যেখানে গত অর্থবছরের চেয়ে ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের সার্বিক রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের চিত্রে অর্থনৈতিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমদানি নেতিবাচক, মানে অর্থনীতি ভালো চলছে না। বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার মানে হলো আগের মতো উৎপাদন হচ্ছে না। তাহলে রাজস্ব আসবে কীভাবে? 

রাজস্ব ঘাটতি ১৫ হাজার কোটি টাকা
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এই সময়ে শুল্ক-কর মিলিয়ে আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ১৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা।

>তিন মাসে ঘাটতি ১৫ হাজার কোটি টাকা
নতুন আইনে অভ্যস্ত হতে পারেননি ব্যবসায়ী ও ভ্যাট কর্মকর্তারা

রাজস্ব আদায়ের প্রধান তিনটি খাত হলো আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক-কর, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট এবং আয়কর। এই তিনটি খাতের মধ্যে দুটিতে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, বরং আগের চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে।

আলোচ্য জুলাই-সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ভ্যাট আদায় কমেছে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা। এ বছর এই খাতে আদায় হয়েছে ১৭ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি) জামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাময়িক হিসাবে আদায় কিছুটা কমেছে। চূড়ান্ত হিসাবে বাড়বে বলে আশা করা যায়। নতুন আইনের কোনো প্রভাব আছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাত্র তিন মাস হলো নতুন আইনটি চালু হয়েছে। এখনো আইনটি সম্পর্কে ভ্যাট কর্মকর্তা ও ভ্যাটদাতাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আইনটিতে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লাগবে। আস্তে আস্তে ভ্যাট আদায়ও বাড়বে।’ 

নতুন আইনে ইবিআইএন ছাড়া ভ্যাট দেওয়া যায় না। কিন্তু ওয়েবসাইটে গিয়ে এই নিবন্ধন নিতে পারছেন না অনেক ইবিআইএন–প্রত্যাশী। তাই তাঁদের ধরনা দিতে হচ্ছে ভ্যাট কার্যালয়ে। এখনো ব্যবসায়ীদের কাছে ভ্যাট দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজবোধ্য হয়নি। এনবিআরকে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। 

এ নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সংস্কারের নামে যা হয়েছে, তা আসলে সংস্কার নয়। অটোমেশন ছিল নতুন আইনের মূল বিষয়। কিন্তু সরকার অটোমেশন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফল ভোগ করছি এখন, হয়রানি বেড়েছে। ভ্যাট আদায় কমেছে।’ 

আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে ২১ হাজার ৫১ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৪ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। শুধু লক্ষ্য থেকেই ঘাটতি নয়; আগের বছরের একই সময়ের চেয়েও কমেছে ২০০ কোটি টাকার মতো।

আয়করে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এই খাতে ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা। 

চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। 

আমদানি-রপ্তানিতে ভাটা
মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, পেট্রোলিয়াম পণ্য—এই তিনটি পণ্যের আমদানি পর্যায়ে সাধারণত বেশি রাজস্ব আদায় হয়। যত ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়, এর অর্ধেকই এই তিনটি পণ্যে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে তিনটি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ আগের বারের চেয়ে কমেছে। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতিতে সাড়ে ১২ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামালে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যে ৫৬ শতাংশ এলসি নিষ্পত্তি কমেছে। 

এ ছাড়া রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে পোশাকশিল্প থেকে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে এই খাতে রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফলে পোশাক মালিকদের কাছ থেকে উৎসে কর আদায়ে প্রভাব পড়েছে।