দেশজুড়ে দেশি সিমেন্ট

সিমেন্টে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। চাহিদার চেয়েও বেশি উৎপাদনক্ষমতা। মেঘনা ঘাটে ফ্রেশ সিমেন্টের কারখানা। ছবি: হাসান রাজা
সিমেন্টে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। চাহিদার চেয়েও বেশি উৎপাদনক্ষমতা। মেঘনা ঘাটে ফ্রেশ সিমেন্টের কারখানা। ছবি: হাসান রাজা

দেশে সিমেন্টের বাজার দ্রুত বাড়ছে। শুধু রাজধানী ঢাকা বা বড় শহর নয়, সিমেন্টের চাহিদা তৈরি হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামেও। তবে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সিমেন্টের এই চাহিদার সিংহভাগ মেটাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।

তাঁরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো জটিল অবকাঠামোতে যেমন সিমেন্ট সরবরাহ করছেন, সাধারণ ভবনের সিমেন্টও তাঁদের কারখানায় তৈরি। গুণগত মান, সরবরাহের সক্ষমতা কিংবা বিপণন কৌশল, কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই দেশীয় কোম্পানিগুলো। ফলে একসময় সিমেন্ট খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর যে বাজার হিস্যা ছিল, তা কমে গেছে।

ভারী শিল্পে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার অন্যতম উদাহরণ সিমেন্ট খাত। এখন দেশে ৩৮টি সিমেন্ট কারখানার মধ্যে ৩৪টি উৎপাদনে আছে। এর মধ্যে ৩০টিই দেশীয় কোম্পানি। সব কোম্পানি মিলে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ১৩ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন করেছে। ২০১২ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বাজার হিস্যা ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ, গেল বছর ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি আলমগীর কবিরের মতে, দেশীয় উদ্যোক্তাদের এই সাফল্যের কারণ সাহস, বিচক্ষণতা ও সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। দেশীয় উদ্যোক্তারা অনুধাবন করেছিলেন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে। তাই তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন।

দেশে প্রথম সিমেন্ট কারখানা হয় ১৯৪১ সালে, সিলেটের ছাতক উপজেলার সুরমা নদীর তীরে। নাম ছিল আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি। স্বাধীনতার পরে ছাতক সিমেন্ট বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসির) অধীনে যায়। স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং ফ্যাক্টরি নামের একটি কারখানা হয়, যা বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

বসুন্ধরা সিমেন্ট জানিয়েছে, ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত মেঘনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশ আমলে দেশীয় মালিকানায় দেশের প্রথম বেসরকারি খাতের মিল। সিমেন্ট খাতে বড় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন ২০০০ সাল এবং এর পরের দু–তিন বছরে। ২০০০ সালে মেট্রোসেম সিমেন্ট, ২০০১ সালে ক্রাউন সিমেন্ট ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ২০০২ সালে শাহ্‌ সিমেন্ট, ফ্রেশ সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট ও আনোয়ার সিমেন্ট, ২০০৩ সালে আমান সিমেন্ট ও মীর সিমেন্ট বাজারে আসে। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সর্বশেষ চলতি বছর বেঙ্গল গ্রুপের বেঙ্গল ব্র্যান্ডের সিমেন্ট বাজারে এসেছে। আর পুরোনো কোম্পানিগুলো নিয়মিত বিরতিতে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে।

উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে সিমেন্ট তৈরি করেন। সিমেন্টের মূল উপাদান ক্লিংকার, জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ ইত্যাদি মূলত বিদেশ থেকেই আসে। বড় গ্রুপগুলো সিমেন্ট উৎপাদনে আধুনিক ভার্টিক্যাল রোলার মিল (ভিআরএম) প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

সক্ষমতা চাহিদার বেশি

দেশীয় সিমেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদনে থাকা ৩৪ কারখানার বার্ষিক স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা ৭ কোটি ৩০ লাখ টন। তবে কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা কিছুটা কম, প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ টন। যদিও দেশে চাহিদা ততটা নয়। এ কারণে সিমেন্ট কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারে না।

২০১৮ সালে দেশে ৩ কোটি ১৩ লাখ টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে। প্রতি টন ৮ হাজার টাকা হিসাবে সিমেন্টের বাজারের আকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেড় দশক আগে সিমেন্ট রপ্তানির দ্বার খুললেও সেটি খুব বেশি এগোতে পারেনি। গত ২০১৮–১৯ অর্থবছরে মাত্র ১ কোটি ৪ লাখ ডলারের সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি সিমেন্ট মূলত ভারতে যায়। আসামের বেশ কিছু বড় প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশি সিমেন্ট।

ব্যক্তি খাতেই বেশি

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিডব্লিউ রিসার্চ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সিমেন্ট মার্কেট রিপোর্ট ২০১৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি অবকাঠামো উন্নয়নে সিমেন্টের ব্যবহার ৩৫ শতাংশ। ব্যক্তি উদ্যোগে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার ৪০ শতাংশ। আবাসন খাতে তা ২৫ শতাংশ।

সিমেন্ট খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগেও ব্যক্তি খাতে সিমেন্টের চাহিদা ছিল মোট বাজারের ৬০ শতাংশ। অন্য খাতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন সেখানকার চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। এ ছাড়া বর্তমানে সিমেন্টের বাজারের ২৫ শতাংশ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নকাজ, ১০ শতাংশ শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবন, ১০ শতাংশ আবাসন খাত এবং বাকি ৫ শতাংশ বৈদ্যুতিক খুঁটি ও কংক্রিটের দখলে রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি মেগা প্রকল্প ও উন্নয়নমূলক কাজে সিমেন্টের চাহিদা যে হারে বেড়েছে, ব্যক্তি খাতে সেভাবে বাড়েনি।

বাংলাদেশ ২০তম

সিমেন্টের বৈশ্বিক বাজারের আকারও অনেক বড়। গ্লোবাল সিমেন্ট প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে ৪১২ কোটি ৯০ লাখ টন সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়। ওই বছর সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৬১৩ কোটি ৮০ লাখ টন। সিমেন্টের বাজারের আকার ছিল ৩৯৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

নির্মাণ উপকরণ সিমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই উন্নীত হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বের ২০তম। দুই বছরের ব্যবধানে তিন ধাপ এগিয়ে এ অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিমেন্ট খাতের পোর্টাল সেমনেট ডটকম প্রকাশিত ‘গ্লোবাল সিমেন্ট রিপোর্ট’–এর সর্বশেষ সংস্করণে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতি দুই বছর পরপর বিশ্বের সিমেন্ট খাতের তথ্য–উপাত্ত নিয়ে এ সমীক্ষা প্রকাশ করে তারা। ২০১৭ সালে সর্বশেষ প্রকাশনা বের করে ওয়েব পোর্টালটি।

ওই প্রকাশনায় বলা হয়, দেশভিত্তিক সিমেন্ট ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপরের অবস্থান ভারতের। ২০১৬ সালে চীনে সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় ২৩৯ কোটি টন। ভারতে ব্যবহৃত হয় প্রায় ২৯ কোটি টন। ওই বছর ২০তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয় ২ কোটি ৩০ লাখ টন।

সম্ভাবনা বড়

দেশের সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর) সিমেন্টের বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ। বছর শেষে তা ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে থাকবে। প্রথম ৯ মাসে আড়াই কোটি টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে। বছর শেষে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টনে। চলতি বছর সরকার কয়েকটি বড় প্রকল্পে সিমেন্টের ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণেই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে বলছেন উদ্যোক্তারা।

বসুন্ধরা সিমেন্টের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) খন্দকার কিংশুক হোসেইন মনে করেন, পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সরবরাহব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়ে এবং তুলনামূলক কম দামে পণ্য সরবরাহ করে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সিমেন্ট কারখানা এগিয়ে গেছে। তিনি বলেন, রূপপুরের পারমাণবিক চুল্লি বসানোর আশপাশের মাটি শক্ত করার প্রয়োজন হয়েছে। এই মাটিতে একটি বিশেষ ধরনের সিমেস্ট (ব্লাস্ট ফার্নেস) সিমেন্ট ব্যবহার করতে হয়েছে, যা বসুন্ধরা সরবরাহ করেছে।

 মোট ব্যবহারে সেরা ২০ দেশের তালিকায় থাকলেও মাথাপিছু ব্যবহার এখনো কম। এমআই সিমেন্টের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সিমেন্টের মাথাপিছু ব্যবহার ছিল ১৬৪ কেজি। উদ্যোক্তারা বলছেন, সাধারণত সিমেন্ট খাতে মাথাপিছু ব্যবহার ৬০০ কেজি হলে প্রবৃদ্ধির গতি কমতে থাকে। এ তথ্য বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে এখনো সিমেন্ট খাতে তিন গুণ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।