কারখানায় এখনো তালাবদ্ধ ফটক

তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি, ক্ষতিপূরণের জাতীয় মানদণ্ড নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) নেতা–কর্মীরা মানববন্ধন করেন। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে। ছবি: প্রথম আলো
তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি, ক্ষতিপূরণের জাতীয় মানদণ্ড নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) নেতা–কর্মীরা মানববন্ধন করেন। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে। ছবি: প্রথম আলো

তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগার পরপরই কারখানার তৃতীয় তলার ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়। যে কারণে অনেক শ্রমিকই বের হতে পারেননি। ফলে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি হয়। ওই দুর্ঘটনার পরপরই তৈরি পোশাক কারখানার তালাবদ্ধ ফটক অপসারণে শক্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সাত বছর পরও কিছু কারখানায় তালাবদ্ধ ফটকের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।

তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল রোববার। তবে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর হওয়া মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলার বিচারকাজে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। মামলার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বর্তমানে জামিনে আছেন। তিনি পোশাক রপ্তানির ব্যবসাও করছেন।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক পুড়ে মারা যান। শতাধিক শ্রমিক আহত হন। তাঁদের অনেকেই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হওয়ায় গতকাল গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন জুরাইন কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে আয়োজিত সমাবেশে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। পরপর দুটি ভয়াবহ ঘটনার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। উভয় জোটই পরিদর্শনের মাধ্যমে কারখানা ভবনের অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত করে। পরে কারখানাগুলো সে অনুযায়ী ত্রুটি সংস্কারের কাজ করে।

অ্যাকর্ডের অধীনে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কারখানা। গত মাসে প্রকাশিত জোটের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ কারখানা তালাবদ্ধ ফটক অপসারণ করেছে। তবে এখনো ২ শতাংশ কারখানায় তালাবদ্ধ ফটক রয়ে গেছে। এ ছাড়া ৪৭ শতাংশ কারখানা অগ্নিদুর্ঘটনা শনাক্তের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও অ্যালার্ম স্থাপন করেনি। জরুরি নির্গমন পথে আলোযুক্ত বিশেষ নির্দেশিকা স্থাপন করেনি ৭ শতাংশ কারখানা। অগ্নিদুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি কমাতে এই তিন কাজ করা অত্যাবশ্যকীয়।

সব কারখানার তালাবদ্ধ ফটক অপসারিত না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২ শতাংশের কম কারখানায় এমন ফটক থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেগুলো শ্রমিকেরা কারখানায় কর্মরত থাকার সময় তালাবদ্ধ থাকে না। তারপরও অ্যাকর্ডের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে আমরা প্রতিটি কারখানায় খোঁজ নিয়ে দ্রুত সেগুলো অপসারণের ব্যবস্থা নেব। কেন তালাবদ্ধ ফটক রয়েছে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি করা হবে।’

তাজরীনের অগ্নিদুর্ঘটনার পরের বছর সিআইডি অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলামসহ ১৩ জন। বর্তমানে আসামিরা সবাই জামিনে। মামলার সাক্ষী ১০৪ জন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। তবে ঠিকমতো সাক্ষী হাজির না করতে পেরে বেশ কয়েকবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। গত চার বছরে মাত্র আটজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। অন্যদের বারবার পরোয়ানা পাঠিয়েও আদালতে হাজির করা যায়নি। সর্বশেষ ৭ নভেম্বর শুনানির দিনও কোনো সাক্ষীকে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. মোর্শেদ উদ্দিন খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্ষীদের অনেকে বর্তমানে আগের ঠিকানায় নেই। তাই তাঁদের আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আনা যাচ্ছে না। আগামী বছরের ৩০ জানুয়ারি পরের শুনানিতে সাক্ষীদের উপস্থিত করানোর জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের পুলিশ সবকিছু বের করতে পারে আর সাক্ষীদের খুঁজে পায় না—বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। সদিচ্ছা থাকলেই সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব। তারা তো দেশ থেকে হাওয়া হয়ে যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘তাজরীনের মতো ঘটনার বিচার না হওয়া মানে পোশাকশিল্পের অন্য মালিকদের বোঝানো যে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে মালিকেরা অন্যায় কাজ করতে কিংবা আইন ভঙ্গ করতে উৎসাহ পাবেন।’