৩৪% ব্যাংক ও লিজিং সর্বনিম্ন দামে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (লিজিং কোম্পানি) মধ্যে ৩৪ শতাংশের দাম গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। শেয়ারবাজারে এ দুই খাতের ৫৩টি কোম্পানির মধ্যে ১৮টিরই দাম গত ৫ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এর মধ্যে ৭টি ব্যাংক আর ১১টি লিজিং কোম্পানি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির গত পাঁচ বছরের দাম পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

শেয়ারবাজারে বর্তমানে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে ৭টি বা সোয়া ২৩ শতাংশের দাম ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ৭টি ব্যাংক হলো এবি, আইএফআইসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, সাউথইস্ট, ঢাকা, ওয়ান ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত লিজিং কোম্পানি বর্তমানে ২৩টি। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ বা ১১টির দাম গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। লিজিং কোম্পানিগুলো হলো ফার্স্ট ফিন্যান্স, পিপলস লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফিন্যান্স, বে লিজিং, আইসিবি ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স।

ডিএসই সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে সাতটি ব্যাংকের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে এবির দাম। এটির শেয়ারের দাম অর্ধেকের বেশি কমে গতকাল দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৭০ পয়সা। ৫ বছর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এটির শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম ছিল সাড়ে ১৭ টাকা। এরপর আইএফআইসি ব্যাংকের দাম ৫ বছরে ৪২ শতাংশের বেশি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের দাম প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিকের দাম ২১ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের দাম ১৬ শতাংশ এবং ঢাকা ব্যাংকের ৯ শতাংশের বেশি কমেছে।

>

বর্তমানে বাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি ৫৩ টি
এর মধ্যে ১৮ টির দাম ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এ ছাড়া আর্থিক বেশ কিছু ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে এ সময়ের মধ্যে। এ কারণে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির মধ্যে অনেকগুলোর আর্থিক অবস্থার বেশ অবনতি ঘটেছে। পাশাপাশি এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থায়ও বড় ধরনের চিড় ধরেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব এ দুই খাতের শেয়ারের দামে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখনো বাজার মূলধন ও লেনদেনে ব্যাংক ও লিজিং খাতের প্রভাব অনেক বেশি। তাই এসব খাতের শেয়ারের দাম কমলে তার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিকভাবে বাজারে ওপরও পড়ে।’

মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, সাধারণত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় মূলধনি কোম্পানি। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের পরিমাণও বেশি। ইচ্ছা করলেই অল্প কিছু শেয়ার কিনে বড় মূলধনী ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির দাম বাড়ানো কিছুটা কঠিন। একে তো আর্থিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে এ দুই খাতের, অন্যদিকে দামও খুব বেশি বাড়ে না এগুলোর। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ কম। একসময় নিরাপদ ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের শীর্ষে ছিল ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শেয়ার। কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছরে পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেছে। বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শেয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অবসায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিতে অবসায়কও নিয়োগ করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে অনেক আমানতকারী তা ফেরত পাচ্ছেন না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারধারীরাও রয়েছেন আতঙ্কে। কোম্পানিটিকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গত জুলাই মাস থেকে শেয়ারবাজারে এটির লেনদেন বন্ধ রয়েছে।

পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে এ খাতের অন্যান্য শেয়ারের দামেও। এ কারণে এ খাতের তালিকাভুক্ত ২৩ কোম্পানির মধ্যে ১১টির দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। স্বাভাবিকভাবে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের দাম। কোম্পানিটি অবসায়িত হলে শেয়ারবাজারে এটির পরিণতি কী হবে, সেই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৭৭ শতাংশ কমে এখন ৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৫ বছরে ৬৯ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ২ টাকা ৭০ পয়সায়। এ ছাড়া বিআইএফসির দাম প্রায় সাড়ে ৬১ শতাংশ, ফার্স্ট ফিন্যান্সের দাম ৫৯ শতাংশ, প্রাইম ফিন্যান্সের দাম ৫০ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের দাম ৪৮ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দাম ৪২ শতাংশ, ফাস ফিন্যান্সের দাম ৩৭ শতাংশ, বে লিজিংয়ের দাম ২৪ শতাংশ, লংকাবাংলা ফিন্যান্সের দাম ২২ শতাংশ ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির দাম১৩ শতাংশ কমেছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৬টি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম দামে লেনদেন হচ্ছে। আর তিনটির দাম অভিহিত মূল্যের কাছাকাছিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তালিকাভুক্ত ২৩টি লিজিং কোম্পানির মধ্যে ৯টি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম দামে লেনদেন হচ্ছে। আর একটির দাম অভিহিত মূল্যের কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ভালো মানের “এ” শ্রেণিভুক্ত একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ করে অর্ধেকের বেশি পুঁজি হারিয়েছি।’