সাধ্যের মধ্যে আবাসন দেওয়া সম্ভব

র‌্যাংগসের বাণিজ্যিক প্রকল্প।  গুলশান তেজগাঁও লিংক রোডে।  ছবি: প্রথম আলো
র‌্যাংগসের বাণিজ্যিক প্রকল্প। গুলশান তেজগাঁও লিংক রোডে। ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো: আবাসন খাতে অনেকেই ব্যবসা করছে। কিন্তু ব্র্যান্ড হতে পেরেছে আপনাদের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এই সাফল্যের মূলমন্ত্র কী?
মাশিদ রহমান: সাফল্যের থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে এটি একটি দীর্ঘ যাত্রা। এই যাত্রার মধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই আছে। তা ছাড়া আবাসন খাতে টিকে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই টিকে থাকাটা কেবল নামে নয়। কারণ, দিন শেষে অধিকাংশ মানুষ তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চয় আবাসনে বিনিয়োগ করেন। ফলে আস্থার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের দীর্ঘ পথচলায় ক্রেতাদের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। তা ছাড়া আধুনিক নকশা ও উদ্ভাবনে সব সময়ই আমরা জোর দিয়ে থাকি। ব্যবহার উপযোগিতার সঙ্গে দেখার (লুক) ব্যাপারটি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে মানের বিষয়ে আপস না করা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরবরাহ ও মানুষের নির্ভরতার কারণে র‍্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেড একটি উচ্চতায় পৌঁছেছে।

প্রথম আলো: রিহ্যাবের এক হাজার সদস্যের অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসা করছে। তাতে জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এখানে নতুন করে চিন্তাভাবনার সুযোগ আছে কি?
মাশিদ রহমান: ভালো পয়েন্ট। তবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বড় প্রতিষ্ঠানকে স্পর্শ করে না। ছোট কোম্পানির বিষয়ে মানুষের একধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। অনেক ছোট কোম্পানি ফ্ল্যাট না বুঝিয়ে দিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। অনেকেই লোকসান গুনেছেন। জমির মালিকেরা এখন আর দুটো টাকা পাওয়ার জন্য যেনতেন কোম্পানির কাছে দেন না। দিন বদলেছে। তারপরও বলব, বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। বিশেষ করে ছোট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সেই প্রতিযোগিতা চলছে। জমি ক্রয়-বিক্রয়েও অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। এটি নিরসনে সরকারের সহযোগিতা লাগবে। বর্তমানে পূর্বাচল, বসিলা, কেরানীগঞ্জের দিকে ঢাকা সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানকার যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি ভালো স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল করার জন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবে তা না করে সরকারের প্রতিষ্ঠান নিজেই ব্যবসায় নেমে গেছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ। এটি সফল করার সহজ সমাধান আছে। ৩০০ ফুট সড়কের দুই পাশে ইউলুপ করে দিতে হবে, যাতে বসুন্ধরা ও পূর্বাচল থেকে সহজে প্রবেশ ও বের হওয়া যায়। তা ছাড়া দেশের সেরা ১০টি স্কুলকে পূর্বাচলে শাখার করার অনুমতি দিতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে। উত্তরা মডেল স্কুল ও স্কলাসটিকা উত্তরায় বসতি গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে চাপ কমাতে হলে আশপাশের এলাকায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।

প্রথম আলো:আগে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল হবে, নাকি আগে আবাসন প্রকল্প করতে হবে?
মাশিদ রহমান: ভালো স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল মানুষকে টানবে। বাজার সৃষ্টি হবে। চিন্তা করে দেখেন, মানুষ কেন সিদ্ধেশ্বরীর দিকে থাকে? কারণ, সেখানে কয়েকটি সেরা স্কুল আছে। তা ছাড়া পাশেই সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ। আসল কথা হচ্ছে ঢাকাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে জন্য অবকাঠামো দরকার। তাতে দাম হয়তো খুব একটা কমবে না, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রা আরামদায়ক হবে।

মাশিদ রহমান, বিভাগীয় পরিচালক, র‌্যানকন হোল্ডিংস লিমিটেড এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, র‌্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেড
মাশিদ রহমান, বিভাগীয় পরিচালক, র‌্যানকন হোল্ডিংস লিমিটেড এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, র‌্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেড

প্রথম আলো:তাহলে কি সাশ্রয়ী দামে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব নয়?
মাশিদ রহমান: আমাদের মতো দেশে কম দামে আবাসন সম্ভব নয়। তবে সাধ্যের মধ্যে আবাসন দেওয়া সম্ভব। সে জন্য মানুষকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য কিছু প্রণোদনা লাগবে। ঢাকায় এখনো কিছু জায়গা আছে, যেখানে প্রকল্প করলে ৫০ লাখ টাকায় ১ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব। তবে সেখানে মানুষকে নিতে হলে ভালো স্কুল করে দিতে হবে। আবার বড় প্রকল্প করা গেলেও দাম কমে যায়। তবে সে ধরনের আবাসন প্রকল্প করার সক্ষমতা আছে মাত্র ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠানের। ৯৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই বছরে তিনটি প্রকল্প করে। সেটিও আবার পাঁচ কাঠার। বড় প্রকল্প করতে হলে ৬০ কাঠার মতো জমি লাগবে। রিহ্যাবের তরফ থেকে রাজউকের কাছে কয়েক দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ‘সাশ্রয়ী মূল্যে বড় জমি দেন। আমরা বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দিই।’ এমনটি হলে সাধারণ মানুষকে সাধ্যের মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব। কারণ, জমির উচ্চ মূল্যের কারণেই ফ্ল্যাটের দাম যায় বেড়ে।

 প্রথম আলো: রাজউক তো কয়েকটি ফ্ল্যাট প্রকল্প করেছে। সেই ফ্ল্যাট কি স্বল্প আয়ের মানুষ কিনতে পেরেছেন?
মাশিদ রহমান: রাজউক নিজে না করে যদি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে দিত, তাহলে অনেক বেশি কাজে দিত। সে ক্ষেত্রে যেনতেন কোম্পানি নয়, শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে হবে। রাজউক যে জায়গায় প্রকল্প করেছে, সেই জমি হয়তো তারা বিনা মূল্যে পেয়েছে। সেটি হলে আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। নীতিনির্ধারক যদি ব্যবসায় নামে, তাহলে আমরা তো টিকে থাকতে পারব না।

 প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি গৃহঋণের সীমা ১ কোটি ২০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ কোটি টাকা করেছে। তাতে কি সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন?
মাশিদ রহমান: ব্যাংকঋণের সুদের হার ১২-১৪ শতাংশ। অধিকাংশ ক্রেতাই ফ্ল্যাট চায় ১ কোটি টাকার নিচে। তাই সাধারণ মানুষের উপকার করতে হলে সুদের হার হ্রাস করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ৮ শতাংশ সুদহার নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। কারা স্বল্প আয়ের মানুষ, সেটি নির্ধারণ করাও সহজ। যেহেতু তারা সাধারণত ছোট আকারের ফ্ল্যাট কেনে, তাই ১ হাজার ২০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ সুদহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণের সুদের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এটি হলে ছোট ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়বে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোও ছোট ও সাশ্রয়ী দামের ফ্ল্যাট করতে উৎসাহিত হবে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: শুভংকর কর্মকার