আবাসন ব্যবসায় গতি ফিরছে

দীর্ঘ মন্দা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে দেশের আবাসন খাত। ফ্ল্যাটের বিক্রি ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফলে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠছে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। সুদিন ফিরতে শুরু করায় নিত্যনতুন প্রকল্পও হাতে নিচ্ছে তারা। তবে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এখনো কোনো সুখবর নেই। কারণ, বিক্রি বাড়লেও ফ্ল্যাটের দাম এখনো আকাশছোঁয়া। আবাসন খাতের ব্যাংকঋণের সুদের হারও বেশি। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কমেনি রেজিস্ট্রেশন ব্যয়।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে ফ্ল্যাটের চাহিদা বৃদ্ধির প্রবণতাটি ইতিবাচক। কারণ, লাফিয়ে লাফিয়ে বিক্রি ও দাম বাড়লে তাতে বাজারে ধস নামার আশঙ্কা থাকে। ফলে ক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। নিবন্ধন ব্যয় ও ব্যাংকঋণের সুদের হার কমানো হলে আবাসনের বাজার আরও ভালো অবস্থায় যাবে। সেটি হলে রড, সিমেন্ট, টাইলস, রং, স্যানিটারিসহ ২৬৯ খাতের ব্যবসাও বাড়বে।

  • রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। তারা বছরে ১০-১২ হাজার ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করছে।
  •  নিবন্ধন ব্যয় ও ব্যাংকঋণের সুদের হার কমানো হলে আবাসনের বাজার ভালো অবস্থায় যাবে।
  • গৃহঋণের পরিমাণ ২ কোটি টাকা করা হয়েছে। তাতে ক্রেতারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও সুদের হার নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন।

২০১২ সালে আবাসন খাতে মন্দা শুরু হয়। পরের বছর টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে সময় ফ্ল্যাটের মূল্য কমিয়েও ক্রেতা খুঁজে পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। কিস্তি দিতে না পারায় অনেক ফ্ল্যাটের ক্রেতা বুকিং বাতিলও করেছেন। সেই অস্থির সময় পার করে ২০১৬ সালের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলেও সংকট কাটেনি। তবে গত বছরের মাঝামাঝিতে সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা আসে। তারপরই ব্যবসা বাড়তে থাকে।

জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে আবাসন খাত আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের গৃহঋণ, গৃহঋণের সীমা বৃদ্ধি করা এবং হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কর্মতৎপরতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষজন আগের চেয়ে বেশি হারে ঋণ পাচ্ছেন। এর ফলে ফ্ল্যাটের চাহিদা বেড়েছে।

দেশে স্বল্প জায়গায় কীভাবে বেশি মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেই চিন্তা
থেকেই দেশে আবাসন ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। শুরু করেছিলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম। তাঁর দেখানো পথ ধরেই ধীরে ধীরে অন্যরা আবাসন ব্যবসায় আসেন। বর্তমানে রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। তারা বছরে ১০-১২ হাজার ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করছে। সেই হিসাবে গত চার দশকে কয়েক লাখ ফ্ল্যাট ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তারা। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ায় খাতটির প্রতি আস্থাও হারিয়েছেন অনেক ক্রেতা। তবে রিহ্যাবের নেওয়া নানা উদ্যোগের কারণে ক্রেতা হয়রানি কিছুটা কমেছে। 

নিবন্ধন ব্যয় কমেনি
ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন ফি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত ছয় মাসেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কবে হবে সেটিও কেউ বলতে পারছেন না। নিবন্ধন ফি না কমায় ফ্ল্যাট বিক্রিতে পুরো গতি আসছে না বলে অভিযোগ আবাসন ব্যবসায়ীদের।

জানা যায়, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের নেতারা গত বছর আবাসন খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি এনবিআর, গণপূর্ত ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি করে দেন। সেই কমিটির প্রথম বৈঠকে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে নিবন্ধন ব্যয় কমানো, সম্পদ কর হ্রাস, কর অবকাশ সুবিধা, এক অঙ্কের সুদহারে গৃহঋণ দেওয়ার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠনসহ ১২ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ফ্ল্যাট ও প্লটের নিবন্ধন ব্যয় কমানোর বিষয়ে রিহ্যাবের নেতারা কমিটিকে বলেছিলেন, বর্তমানে ফ্ল্যাট নিবন্ধনে ৪ শতাংশ গেইন ট্যাক্স, ৩ শতাংশ স্ট্যাম্প ফি, ২ শতাংশ নিবন্ধন ফি, ২ শতাংশ স্থানীয় সরকার কর ও ৩ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) লাগে। তাঁদের প্রস্তাব নিবন্ধন ফি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। এ ছাড়া সেকেন্ডারি বাজার প্রচলনের জন্য পুরোনো ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে আবাসন ব্যবসায়ীদের এই সংগঠন।

যৌথ কমিটি কয়েকটি বৈঠক করে গত মার্চে একটি সুপারিশ চূড়ান্ত করে। সেই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনুমতি নিয়ে গত ২৯ মে স্ট্যাম্প ডিউটি ৩ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ নামিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে চিঠি দেয় এনবিআর। একই সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ফি ২ থেকে ১ শতাংশ নামিয়ে আনতে আইন ও বিচার বিভাগে; স্থানীয় সরকার কর ২ থেকে দেড় শতাংশ করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং ভূমি উন্নয়ন সংস্থার মূসক ৩ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে মূসক নীতি বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়। তবে সাড়ে ছয় মাসেও সেসব বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

এদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের আবাসন খাত দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। খাতটি বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফি অনেক বেশি। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আর অপ্রদর্শিত আয়ের পরিমাণও বাড়ছে। আমরা এসব ফি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করব।’

সুদের হার বেশি
উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে পকেটের টাকায় ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। সে জন্য অনেকেই গৃহঋণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যান। তবে সেখানেও সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ সুদহারের কারণে অনেকের পক্ষেই গৃহঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহঋণের পরিমাণ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২ কোটি টাকা করেছে। তাতে ক্রেতারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও সুদের হার নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন।

জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকঋণের সুদহার না কমানো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। ঋণ দিতে হবে ২০-৩০ বছরের জন্য, যাতে ক্রেতারা ভাড়ার টাকায় ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন। এখনই সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো সম্ভব না হলে অন্তত ছোট ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কমানো দরকার। কারণ, স্বল্প আয়ের মানুষ ছোট ফ্ল্যাটই বেশি কেনেন। সেদিকেই প্রথম নজর দিতে হবে।