কোন পথে হাঁটছে বৈশ্বিক অর্থনীতি

চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নানামাত্রিক শঙ্কাই ছিল একমাত্র বাস্তবতা। বছরজুড়েই বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এই শঙ্কার উৎপাদন হয়েছে, একসময় যার কেন্দ্র পুরোপুরি দখল করে নেয় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলা বাণিজ্যযুদ্ধ। বছরের শেষ মাসে এসে দুই দেশের মধ্যে হওয়া প্রাথমিক বাণিজ্য সমঝোতার খবর এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি আভাস দিলেও তা এখনো যথেষ্ট নয়। কারণ, চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এমন বিরাট সংকট তৈরি হয়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে পুরো বিশ্বকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে নেমে আসবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদন কমবে দশমিক ৮ শতাংশ। এই যখন প্রেক্ষাপট, তখন বিশ্বের অর্থনীতির শুশ্রূষায় নানা দাওয়াই হাজির করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকটকে অনেক তাত্ত্বিকই পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত সংকট হিসেবে দেখছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার কথাও বলছেন। তাঁদের দৃষ্টি মূলত ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদবৈষম্যে নিবদ্ধ। বৈশ্বিক বৈষম্য সূচকের তথ্যমতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম মানুষের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৮৪ শতাংশ। আর ৬৪ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অর্থনীতিবিদদের একাংশ অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বণ্টন—দুই ক্ষেত্রেই সমান মনোযোগ দেওয়ার কথা বলছে। আবার অন্য দল হাজির করছে অনুদান অর্থনীতির দাওয়াই। তাদের ভাষ্য, পুঁজির অসুখ সারাতে হলে কাঠামোর ভেতরে থেকেই তা করতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন শতকোটিপতিদের (বিলিয়নিয়ার) আরও বেশি উদার হওয়া।

তর্কাতীতভাবেই বিশ্ব এখন পুঁজিতন্ত্রের অধীনে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল সুরটি এখন শ্রম, বেসরকারি পুঁজি, বিকেন্দ্রীকৃত ও মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদনব্যবস্থার তারে বাঁধা, যেখানে অধিকাংশ বড় অর্থনীতিতেই শ্রমিক ইউনিয়নের বিষয়টি ক্রমেই ইতিহাস হয়ে উঠছে। অতি মুনাফালোভী করপোরেট পুঁজি বোধগম্য কারণেই শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ভেঙে দিয়েছে। ফলে মজুরি নিয়ে দর-কষাকষির সুযোগ সংকুচিত হয়েছে শ্রমিকদের। এরই অবধারিত ফল হিসেবে হাজির হয়েছে ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদবৈষম্য।

এ অবস্থায় রে দালিওর মতো কয়েকজন শতকোটিপতি প্রকাশ্যেই পুঁজিকাঠামোটি ঘষেমেজে নতুন রূপে হাজির করার কথা বলছেন। তাঁদের ভয় সারা বিশ্বে ক্রমে বিস্তার পাওয়া গণ-আন্দোলনকে। গ্রিনউইচ ইকোনমিক ফোরামে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রে দালিও সরাসরি নিজের শঙ্কার কথাটি বলেছেন। নিজ দেশের রাজনীতিকদের প্রতি তাঁর আহ্বান, ‘মার্কিন রাজনীতিবিদদের উচিত বিদ্যমান সম্পদবৈষম্যকে জাতীয় জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে এটি মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নয়তো সহিংস বিক্ষোভের জন্য প্রস্তুত থাকা, যেখানে আমরা সবাই পরস্পরকে হত্যায় উদ্ধত হব।’

রে দালিওর মতো শতকোটিপতিদের শঙ্কাটি স্পষ্ট। বিদ্যমান অতি মুনাফালোভী করপোরেট পুঁজির ভাবগতিক সোনার ডিমপাড়া হাঁসের পেট চিরে দেওয়ার দিকেই যাচ্ছে। আর তেমনটি হলে নিজেদের সম্পদের পাহাড়টি উধাও হতে তো সময় লাগবে না। তাই তাঁরা একটি সংস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছেন, যার মূল কথা হচ্ছে পুঁজিপতিরা যেন তাঁদের হাতটি আরেকটু আলগা করেন, যাতে দরিদ্রদের হাতে চুইয়ে পড়া অর্থের পরিমাণ ততটা বেশি হয়, যতটায় তারা শান্ত থাকে। এই শান্ত রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে পুঁজির সংকটকালে এমন অনেক প্রস্তাবই আসছে। মোটাদাগে এসব প্রস্তাবের অনেকগুলোকেই চরিত্রে সমাজতান্ত্রিক নীতির দিকে ঝুঁকে পড়া বলে ভ্রম হয়। কারণ, এসব প্রস্তাবের প্রায় সব কটিতেই মূলত আয় ও সম্পদবৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাব উত্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বণ্টনব্যবস্থার ‘ন্যায্যকরণ’-এর মতো নানা চটকদার শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এই শব্দগুলোর ভ্রম থেকে বাইরে এসে স্বচ্ছ চোখে তাকালেই ভ্রান্তিটি কেটে যেতে বাধ্য। কারণ, এটা মূলত পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রস্তাব ছাড়া আর কিছুই নয়, যা একে রাজার আসনে টিকিয়ে রাখার জন্যই করা হচ্ছে। কথা হচ্ছে, এই কাঠামো কি তবে অন্য কোনো কিছু দ্বারা আক্রান্ত? উত্তর হচ্ছে, ‘হ্যাঁ’। কিন্তু সেই পাল্টা কাঠামোটি তবে কী? এর উত্তর হচ্ছে, ‘পুঁজি’।

হ্যাঁ, পুঁজির দুটি কাঠামোর মধ্যেই এখন মূল বিবাদ। একটি নিয়ন্ত্রিত পুঁজি, অন্যটি উদারনৈতিক পুঁজি। এর একটির ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটির চীন। বিশ্বের ইতিহাসে যেকোনো মতবাদের ক্ষেত্রেই সময়ের সঙ্গে একাধিক ধারা ও তাদের মধ্যকার লড়াই কোনো নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদও এর ব্যতিক্রম নয়। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ—কথাটি মোটাদাগে বলা হলেও এর মধ্যে রয়েছে দুটি কাঠামোর লড়াই, যার একটি অন্যটি থেকে রাজনীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধারা—সব দিক থেকেই আলাদা।

উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যে পুঁজিবাদী কাঠামো অনুসৃত হয়, তা উদারবাদী হিসেবে পরিচিত। এই ধারায় উৎপাদনব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ছেড়ে দেওয়া হয় বেসরকারি মালিকানায়। মেধার বিকাশ, সম্পদ অর্জন, সুযোগের সাম্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটি ছদ্ম স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করা হয় এ ধরনের ব্যবস্থায়। আদতে এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র শীর্ষ সম্পদধারীদেরই আনুকূল্য দেয়। এই পুরো ব্যবস্থা পুঁজির উদারবাদী ধারা হিসেবে পরিচিত। এর বিপরীতে রয়েছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের মডেল, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে চীন। কাছাকাছি ধারার পুঁজিকাঠামো অনুসৃত হয় মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, আজারবাইজান, রাশিয়া, আলজেরিয়া, রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে। এই ব্যবস্থা উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুকূল হলেও ব্যক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সংকুচিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উল্লিখিত দুটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

পুঁজির এই দুটি ধারা বরাবরই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বর্তমানে এই প্রতিযোগিতা এতটাই বেড়েছে যে, তা বিশ্বের সামনে বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবে হাজির হয়েছে। এ দুই ধারা পরস্পরের ওপর আবার নির্ভরশীলও। এই প্রতিযোগিতা ও নির্ভরশীলতা একই সঙ্গে চলছে। বলা যায়, নির্ভরশীলতাকে অগ্রাহ্য করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার বিকল্প দুই পক্ষের সামনে নেই।

কারণ, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বাস এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে, যার দখলে আবার বৈশ্বিক মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৮০ শতাংশ। ফলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রম, প্রযুক্তি ও ধারণার বিনিময় এই দুইয়ের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার পৃথক মডেল হওয়ায় প্রতিযোগিতারও কোনো বিকল্প নেই। এই প্রতিযোগিতাই এখন দেখছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, যার ফলাফলটিই মূলত ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কাঠামোটি গড়ে দেবে। তবে সেই ফলাফল নিশ্চিতভাবেই বৈষম্যে নাকাল অগণিত মানুষের উপশম হয়ে আসবে না। কারণ, দুই পক্ষের মধ্যেই আগ্রাসনের অদম্য স্পৃহাটি স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোটিকে সামনে আনতে হলে এই ধারার নেতাদের একটি শক্ত উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, যা বিশ্বের শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষের একটি উন্নত বিকল্পের আশ্বাস দেবে। দৃষ্টিগ্রাহ্য উদাহরণ ছাড়া মানুষকে পাশে পাওয়ার তেমন কোনো আশা নেই। কারণ, নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতেই তারা নাকাল, কোনো তত্ত্বকথায় যার নজর ফিরবে না।

(আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব)