আকর্ষণীয় থাকবে না আর ব্যাংক ব্যবসা

আরফান আলী, এমডি, ব্যাংক এশিয়া
আরফান আলী, এমডি, ব্যাংক এশিয়া
>

২০১৯ সালটি ছিল ব্যাংক খাতের জন্য আলোচিত বছর। বছরজুড়ে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এখন উৎপাদন খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: সারা বছরই আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত। কেমন গেল ২০১৯ সাল?

আরফান আলী: চলতি বছরে ব্যাংক খাত খুব ভালো বা খারাপ করেছে, তা বলা যাবে না। মোটামুটি ভালো গেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এসব নিয়ে ব্যাংকগুলো একধরনের চাপে ছিল। তবে চলতি বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো হয়েছে। এ জন্য ব্যাংক খাতের যে সমর্থন প্রয়োজন ছিল, তা দেওয়া গেছে। এভাবে কত দিন সমর্থন দেওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। অনেক ঋণ খারাপ হয়ে পড়ছে, এসব ঋণ পুনঃ তফসিল হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের হাতে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল কতটা থাকবে, এটা বড় প্রশ্ন। যাঁরা খেলাপি হয়ে পড়েছেন, তাঁদের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা কাজে লাগলে ভালো হবে।

প্রথম আলো: সারা বছরই কয়েকবার সুদহার কমানোর ঘোষণা দেওয়া হলো। বছর শেষে এসে এখন উৎপাদন খাতে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। এই বেঁধে দেওয়া সুদহারের প্রভাব কী হবে?

আরফান আলী: সব ব্যাংক কম সুদে ঋণ দিতে প্রস্তুত নয়। প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকের তহবিল ব্যয় আলাদা। এটা নির্ভর করে ব্যাংকের সুনাম, আকার, পরিচালনা নীতি, সম্পদ দায় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর। তাই প্রতিটি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারও পৃথক। এখন সরকার জিডিপিকে প্রাধান্য দিয়ে উৎপাদন খাতে সুদ কমাচ্ছে, এটা ভালো। তবে এতে আর্থিক খাতে দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, হঠাৎ করে সুদহার কমে গেলে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। তাতে মুনাফা কমবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাজস্ব আদায় ও শেয়ারবাজারে। যেকোনো সুদহার বাস্তবায়নে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। কারণ, উচ্চ সুদে ৬ মাস মেয়াদি যেসব আমানত আছে, তার বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রথম আলো: ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। ঋণের সুদ নির্দিষ্ট করায় এবারও কি ব্যাংকগুলো একই পথে যাবে?

আরফান আলী: ঋণের সুদ যা–ই হোক না কেন, আমানতের সুদ হঠাৎ করে কমানো ঠিক হবে না। কারণ, যারা ব্যাংকে টাকা রেখে দিন যাপন করে, তাদের জন্য এটি পীড়াদায়ক হবে। একটি বিষয় আমরা খেয়াল করছি না, সেটা হলো, ভালো গ্রাহক ও খারাপ গ্রাহক কি একই সুদে ঋণ পাবে? তাহলে তো ভালো ও খারাপ গ্রাহকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকল না। এমনটি চললে ভালো ও খারাপ ব্যাংকের মধ্যেও কোনো পার্থক্য থাকবে না। পুরো অর্থনীতির জন্য এটি মোটেই ভালো সংবাদ নয়। আমি মনে করি, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

প্রথম আলো: আমানতের সুদ না কমিয়ে ব্যাংকগুলো কীভাবে ঋণের সুদ সমন্বয় করবে?

আরফান আলী: এ জন্য আমাদের ২০ থেকে ২৫ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। ওই সময়ে যারা ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছিল, তারা উচ্চ মুনাফা পেয়েছে। অল্প সময়ে বিনিয়োগ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অন্য খাতে বিনিয়োগ থেকে কিন্তু তত মুনাফা আসেনি। এ জন্য অনেকেই ব্যাংকের মালিক হয়েছেন, এখনো হতে চান। ঋণের সুদ কমলে ব্যাংকের মূলধন থেকে যে আয় হয়, পোশাক কারখানা ও কৃষি খাতের বিনিয়োগ থেকেও সমান আয় হবে। এটা বাজারের শৃঙ্খলার জন্য খুবই ভালো। তাতে ব্যাংক ব্যবসা আর আকর্ষণীয় থাকবে না। এমনকি কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা না মেনে এ ব্যবসা করলে মুনাফা করাই কঠিন হয়ে পড়বে। এই চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো কম খরচে নতুন সেবা আনবে। ব্যাংকগুলো দক্ষতা বাড়াতে বাধ্য হবে। উচ্চ খরচে নতুন শাখা খুলে ব্যবসা আর চলবে না।

প্রথম আলো: বছরজুড়ে ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়া হলো। তারা কি ঋণ পরিশোধে এগিয়ে এসেছে?

আরফান আলী: সুদহার কমলে আয় কমে যাবে। তাই ব্যাংকগুলো খেলাপিদের থেকে টাকা ফেরত আনতে বেপরোয়া হয়ে উঠবে। যত ধরনের ব্যবস্থা আছে, তার সবই প্রয়োগ করবে। খারাপ ঋণ আর তৈরি হবে না। একটা কথা আছে, ভালো সময়ে খারাপ ঋণ তৈরি হয়। তাই বর্তমান খারাপ সময়ে খারাপ ঋণ হবে না, এমনটাই আশা করি। নানা ধরনের সুবিধা দেওয়ার কারণে অনেক ঋণখেলাপি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন। ঋণ পরিশোধে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই আশা করছি, খেলাপিদের বড় অংশ নিয়মিত হবেন এবং ভালো গ্রাহক হয়ে উঠবেন।

প্রথম আলো: ব্যাংকগুলোর ঋণমান খারাপের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমস্যা বাড়ছে কি? কাঙ্খিত জিডিপির জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন তার জন্য ব্যাংকগুলো কতটা প্রস্তুত?

আরফান আলী: আমাদের অর্থনীতি এখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা কখনো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। এরপরও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মাশুল অনেক বেশি। খরচ আরও বেড়ে গেলে সেটা আমাদের জন্য বড় আঘাত হবে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে আমাদের ওপর চাপ আছে। ব্যাংকগুলো এখনো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। এটা একটা বড় ভুল পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য বন্ড ছাড়তে হবে। বন্ড বাজারের উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্ডের নিয়মনীতিগুলো সবাই মানতে চায় না।

প্রথম আলো: ২০২০ সালে ব্যাংক খাতে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আরফান আলী: সুষ্ঠুভাবে তারল্য ব্যবস্থাপনা করাই হবে নতুন বছরের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বছরটিতে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলো ব্যস্ত থাকবে। সরকারের ঋণ যেহেতু বাড়বে, তাই সুদহার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে।