২০১০-১৯: এটাই সেরা দশক

>সুইডিশ লেখক ও ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার জোহান নরবার্গ ছয়টি যুক্তি তুলে ধরে ২০১০-১৯-কে সেরা দশক বলেছেন। জেনে নিন কারণগুলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। তিনি আবার নোবেলজয়ী সাহিত্যিকও। চার্চিলের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘একজন হতাশাবাদী প্রতিটি সুযোগে অসুবিধা দেখেন, একজন আশাবাদী প্রতিটি অসুবিধায় সুযোগ দেখে থাকেন।’
নতুন বছরের প্রত্যাশা হিসাব করার ক্ষেত্রে চার্চিলের এই উক্তি আসলে মাথায় রাখায় উচিত। ২০১০ থেকে ২০১৯ হয়তো অনেক আশঙ্কা, অনেক দ্বন্দ্বে কেটেছে। তবে এই এক দশকে বিশ্বের প্রাপ্তিও কম নয়।
সুইডিশ লেখক ও ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার জোহান নরবার্গ মনে করেন, বিগত ১০ বছর (২০১০-১৯) বিশ্বের ইতিহাসের সেরা দশক। নরবার্গ ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ক্যাটো ইনস্টিটিউটে সিনিয়র ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘এই দশকের প্রাপ্তির জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’
নরবার্গ মনে করেন, বিগত দশকে প্রতিদিন বিশ্ব নানা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছে। মূলধারার মূল্যায়নের সঙ্গে হয়তো সেটি মেলে না। কারণ, অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এই দশকেই বিভিন্ন দেশ গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, জলবায়ু বিপর্যয় মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সঙ্গে পুঁজিবাদ মানবতাবোধকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ, ইরান সংকট, মধ্যপ্রাচ্যের নানা অস্থিরতার ঘটনা তুলে ধরে আবার অনেকে নরবার্গের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন।
তবে তথ্য-উপাত্ত কিন্তু আমাদের এতটা নিরাশ করে না। নরবার্গ সেই তথ্য-উপাত্ত দিয়েই বলছেন, এই দশক হচ্ছে মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতির এক গল্পগাথা। সেরা দশক বলার পেছনে নরবার্গ যে ছয়টি যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা একবার চোখ বুলিয়ে দেখা যায়।

১. চরম দারিদ্র্য কমেছে
বিগত ১০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো চরম দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়া। সাধারণত কারও দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের কম হলে তাঁকে চরম দারিদ্র্যের কাতারে ফেলা হয়। ১৯৯০ সালে বিশ্বে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৬ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশে। এর মানে হলো, প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতি থেকে উঠে আসছে।

২. বেড়েছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা
চমকে দেওয়ার মতো একটা তথ্য হলো, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মধ্যবিত্তের কাতারে প্রবেশ করে। অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৩৮০ কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদার কারণে নানা উদ্যোগ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাণিজ্যেরও প্রসার হচ্ছে। ২০০৯ সালে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮০ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৬ শতাংশ।

৩. গড় আয়ু বাড়ছে
বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ১০ বছরে ৩ বছর করে বেড়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়ায় এই সুফল। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে শিশুমৃত্যুর হার ২০০৮ সালে ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এক দশক পর ২০১৮ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৫০ সালের দিকে এমনটা ভাবাও যেত না। এমনকি আফ্রিকার দেশ চাদ, যেখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, তারা পর্যন্ত এই হার ৫৬ শতাংশ কমিয়েছে। মজার বিষয় হলো, বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় চাদই সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। সবচেয়ে উন্নতি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৯৮ শতাংশ।

৪. জলবায়ুজনিত কারণে মৃত্যু কমেছে
নরবার্গ বলছেন, একপর্যায়ে উন্নত দেশগুলো দূষণ কমিয়ে আনে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর হার বিশ্বব্যাপী ৫ ভাগের প্রায় ১ ভাগ কমেছে। চীনে কমেছে এক-চতুর্থাংশ। ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত জলবায়ুজনিত কারণে মৃত্যুর হার কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে এসে প্রতি ১ লাখে এই হার দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা ১৯৬০ সালের চেয়ে ৯৫ শতাংশ কম। এর মানে এই নয় যে বিপর্যয় আসেনি। বিপর্যয় এসেছে, তবে তা মোকাবিলার সক্ষমতা দেশগুলোর বেড়েছে।

৫. দরিদ্র দেশের জীবনমানে উন্নতি
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশটিরও জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে পানীয় জলের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া রান্নার জ্বালানিও সুলভ হয়েছে।

৬. ব্যবসা শুরুর খরচ কমেছে
কঠোর নিয়মকানুন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে বাধা দেয়। অথচ নিজস্ব ব্যবসা দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম উপায়। নিয়ম কঠোর হলে উদ্যোক্তাদের কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যেই পড়তে হয় না, সেই সঙ্গে ব্যবসা শুরু করার ব্যয়ও বেড়ে যায়। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, গত ১০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবসা শুরু করার খরচ ব্যাপক কমেছে। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে ২০০৪ সালে ব্যবসা শুরু করার গড় ব্যয় ছিল মাথাপিছু আয়ের ১৪১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে এসে তা এখন ৩০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
গত নভেম্বরে টুইটারে এই পোস্ট দেন জোহান নরবার্গ। সেই সঙ্গে ২০১০-১৯ দশককে সেরা বলার পেছনে আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন তিনি। সেগুলো হলো এখন পর্যন্ত মানবজাতি যে পরিমাণ সম্পদ তৈরি করেছে, তার ২৮ শতাংশ এই ১০ বছরে তৈরি হয়েছে। নারীর ওপর সহিংস আচরণ প্রতিরোধে কাজ করা দেশের সংখ্যা বেড়েছে। দূষণের কারণে বিশ্বে মৃত্যুর হার ১৯ শতাংশ কমেছে।
আপনার কাছে দশকটি কেমন গেল, সেই বিবেচনা আপনার।