কতটা এগুলো এফ-কমার্স

প্রসার ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রীক ব্যবসার। ছবি: প্রথম আলো
প্রসার ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রীক ব্যবসার। ছবি: প্রথম আলো

প্রথাগত অর্থনীতিতে বাজার বলতে যে ক্রেতা, বিক্রেতা ও স্থান বোঝায় তা অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। বাজার একটি ‘স্থান’ ধারণা বদলাতে বদলাতে এ দশকে এসে যুক্ত করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আরও পরিষ্কার করে বললে মার্ক জাকারবার্গের তৈরি আশ্চর্য প্রদীপ ফেসবুক। সেই আশ্চর্য প্রদীপে ঘষা দিয়ে এগিয়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য, পোশাকি নাম 

এফ-কমার্স। ২০১৯ সালে অন্য সব কিছুর মতো এগিয়ে গিয়েছে এফ-কমার্সও।

সামাজিক যোগাযোগের উপলক্ষে ফেসবুকে প্রতিদিন প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। যেখানেই মানুষ সেখানেই জমে যায় হাটবাজার—এই প্রাচীন ধারণা এখানেও অব্যর্থ। ইংল্যান্ডভিত্তিক ডিজিটাল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি ব্রান্ডওয়াচের দেওয়া এক তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ফেসবুকে ব্যবসা করে প্রায় ৬০ মিলিয়ন পাতা, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসা। ফেসবুকেই শুরু হওয়া ব্যবসা বাংলাদেশ তুলনামূলক পিছিয়ে থাকলেও ই ক্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ৮ হাজার ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা ছিল। ২০১৯–এ এসে গিকিস্যোশাল নামে একটি ডিজিটাল ইনটেলিজেন্স কোম্পানি জানায়, এর সংখ্যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক থেকে তিন লাখ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং গিকি স্যোশালের সহ–উদ্যোক্তা সাইমুম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সবগুলো ফেসবুক পেজ সক্রিয় নয়, অধিকাংশই দেশের প্রচলিত ব্যবসার নিয়মকানুন মেনে ব্যবসা করে না। তবে যারা করে, ২০১৯–এ এসে তাদের সংখ্যাও প্রায় ২০ হাজার। 

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শেষে বাংলাদেশে ৯ কোটির মতো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিলেন, যাঁদের ৮ কোটিই ছিলেন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। ২০১৯–এর নভেম্বর পর্যন্ত মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটির কিছু বেশি, যার ৯ কোটি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। 

২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ সময়ে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি পাওয়ার এর দাম বেড়েছে। ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি হাইপের পরিচালক জুনায়েদ মোস্তফা বলেন, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনা প্ল্যাটফর্মের দেওয়া উপাত্ত বিবেচনা করে আমরা দেখেছি ইন্টারনেটের দাম বাড়া সত্ত্বেও মোবাইল ব্যবহারকারী বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে ইন্টারনেট ও ফেসবুকের ব্যবহার এবং এই মাধ্যমের ব্যবসা। 

ফেসবুকে যেসব ব্যবসা চলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পোশাক, তৈজসপত্র, উপহার সামগ্রী, কসমেটিকস ও জুয়েলারি। এখানে কেউ আছেন যাঁরা এর–ওর কাছ থেকে পণ্য কিনে এনে ফেসবুকে বিক্রি করেন। আবার ফেসবুক তৈরি করেছে উদ্যোক্তাও, যাঁরা একদম উৎপাদন থেকে প্রতিটি ধাপ পার করে ‘বাজারে’ তুলেছেন পণ্য, এ বাজারের নাম ফেসবুক। 

ফেসবুকের এই ব্যবসার ধারণা মূলত ২০১২ থেকে। ‘যদি গত চার বছরের উপাত্ত বিবেচনা করা যায়, কিছু উদ্যোগ ৪০ গুণ বড় হয়েছে, কেউ কেউ ১০ গুণ পর্যন্ত বড় হয়েছে। তবে অন্য সব ব্যবসার মতো এখানেও টিকে থাকা একটা বিষয়, ফলে উদ্যোগগুলোর ঝরে যাওয়ার হারও কম নয়’ বলেন সাইমুম হোসেন।

এফ-কমার্স কত বড় হয়েছে, এর কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে সাইমুম হোসেনের মতে, ‘২০১৫ সালে যখন প্রথম এফ–কমার্স সামিট হয়, মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় করতে পারলে আমরা ব্যবসাটা চলছে এমন বলতাম। ২০১৯-এ তৃতীয় এফ-কমার্স সামিটে এসে আমরা দেখেছি যে ব্যবসাগুলো চলছে, সেগুলো মাসে গড়ে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছে। এ থেকে বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অর্থনীতি বড় হয়েছে।’ 

২০১২ সালে লা মোড নামে একটি জুতার উদ্যোগ ফেসবুক থেকে শুরু করেছিলেন জুতার ডিজাইনার ফাহমিদা ইসলাম। ২০১৯ পর্যন্ত ফাহমিদার এখন চারটা শোরুম ও একটি ওয়েবসাইট আছে। ফাহমিদার জুতা বিক্রি হচ্ছে আমাজনেও। ফাহমিদা বলেন, এত কিছু পরেও ফেসবুকে আমাদের অর্ডার আসে এবং আমরাও পণ্যের প্রচারের জন্য ফেসবুকের ওপরেই আস্থা রাখি বেশি। 

ফেসবুকের ব্যবসার বৃদ্ধির সঙ্গে তৈরি হচ্ছে সহায়ক ব্যবসাও। এর মধ্যে আছে মোবাইল লেনদেনের মতো আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আমদানিকারক ও কুরিয়ারের মতো ব্যবসাগুলো। তবে সবচেয়ে বেশি বড় হয়েছে কুরিয়ার সার্ভিস। এমনকি এফ–কমার্সকে উপলক্ষ করে তৈরিও হয়েছে অনেক কুরিয়ার সার্ভিস, যারা কাজ করে নির্দিষ্ট কিছু উদ্যোগের সঙ্গেই। 

নতুন হওয়া কুরিয়ার সেবার একটি হচ্ছে ই-কুরিয়ার। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা বিপ্লব ঘোষ বলেন, ‘আমার কোম্পানিতে ১৫ হাজার এফ–কমার্সভিত্তিক উদ্যোগ নিবন্ধিত রয়েছে, যাদের মধ্যে চার হাজার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পণ্য চালান করে। যাদের কল্যাণে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯–এ এসে আমার কাজ এবং আয় উভয়ই তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।’ 

অর্থনীতিতে এফ–কমার্স একটি প্রবৃদ্ধির আভাস দিলেও এই ব্যবসাগুলোর অধিকাংশের কোনো আইনি অস্তিত্ব নেই, বলেন সাইমুম হোসেন। তিনি মনে করছেন, ব্যবসাগুলোর আর্থিক লেনদেনের একটি স্বয়ংক্রিয় নজরদারি আবশ্যক। তবে তারও আগে এসব উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন তারা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা চালানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা একটি ছোট উদ্যোগ না থেকে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হচ্ছে, এফ–কমার্সকে মাথায় রেখে সরকারকে নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যেন এ ব্যবসাগুলোও বড় হওয়ার সুযোগ পায়, প্রবৃদ্ধির সুযোগ পায় দেশের অর্থনীতিও।