সম্ভাবনার প্রদীপের নিচে অন্ধকার

নতুন বছরে উঠে দাঁড়াবে হালকা প্রকৌশল খাত, এটাই প্রত্যাশা। ছবি: হাসান রাজা
নতুন বছরে উঠে দাঁড়াবে হালকা প্রকৌশল খাত, এটাই প্রত্যাশা। ছবি: হাসান রাজা

হালকা প্রকৌশলশিল্পের (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং) ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বের অনেক দেশের অটোমোবাইলসহ বড় শিল্পকারখানা দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরেই হালকা প্রকৌশলশিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হালকা প্রকৌশল পণ্যকে ২০২০ সালের বর্ষ পণ্য ঘোষণা করায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের অধীনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোমোবাইল, অটো পার্টস, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি, সোলার ফটো-ভল্টিং মডিউল, বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীসহ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বাংলাদেশ আরও পণ্য উৎপাদন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগ আকৃষ্টে আমাদের অনেক সুযোগ আছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে আমাদের বিশাল বাজার আছে।’

হালকা প্রকৌশলশিল্পের আঁতুড়ঘর পুরান ঢাকা। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেখানকার টিপু সুলতান রোডে মোটরগাড়ি ও পাটকলের যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানার গোড়াপত্তন হয়। পরে কিছু প্রতিষ্ঠান যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করে। কারখানাগুলো ধীরে ধীরে আশপাশের এলাকার পাশাপাশি বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য সম্ভাবনাময় খাতটি একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে গেছে। গাড়ির ইঞ্জিন ও বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্রপাতি মেরামত আর ছোটখাটো নাটবল্টু তৈরিতেই ব্যস্ত অধিকাংশ কারখানা। কিছু প্রতিষ্ঠান কৃষি ও নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ বা মোল্ড, পেপার মিলের রোলার, ব্রেড ও বেকারির যন্ত্র ইত্যাদি তৈরি করছে।

কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে হালকা প্রকৌশল খাতের সম্ভাবনা আছে। তবে নানামুখী সমস্যার কারণে সুযোগটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, নীতি সহায়তা, উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, শিল্পপার্ক স্থাপনে কার্যকর উদ্যোগ নিলে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির ধারণা, পুরান ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় হাজার তিনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা আছে। সারা দেশ হিসাবে নিলে সংখ্যাটি ৫০ হাজারে দাঁড়াবে। তবে ৯০ শতাংশ কারাখানাই গাড়ি ইঞ্জিন থেকে শুরু করে নানা রকম শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি মেরামত করে। বাকি ১০ শতাংশের নাটবল্টুসহ খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করে।

দেশের বিভিন্ন বিসিক শিল্প এলাকা ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) হালকা প্রকৌশলশিল্পের মাঝারি ও বড় কারখানা আছে। সেখানকার অনেক কারখানা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক পণ্য, বাইসাইকেল, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি রপ্তানি করছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ দশমিক ১২ শতাংশ কম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩৫ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার কথা হয়। হালকা প্রকৌশল পণ্যকে ২০২০ সালের ‘বর্ষ পণ্য’ ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। তবে ঘোষণার পাশাপাশি কার্যকর উদ্যোগ না নিলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না বলে মন্তব্য করেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, হালকা প্রকৌশলশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে শিগগিরই ছয়টি কাজ করা দরকার।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল থেকে হালকা প্রকৌশলের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, বর্তমানে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করার মতো অবস্থায় নেই উদ্যোক্তারা। সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল থেকে ঋণের পাশাপাশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল করতে হবে। হালকা প্রকৌশল খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের সামর্থ্য সীমিত হওয়ায় তারা নতুন নতুন পণ্য রপ্তানিতে যেতে পারবেন না। তাই সরকারকে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি কোম্পানি গঠন করতে হবে। সেই কোম্পানির অধীনে থেকে ছোট ছোট কারখানা নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন যেতে পারবে।

এ ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব মুন্সিগঞ্জের শিল্পপার্ক স্থাপন সম্পন্ন করা, সমিতির অধীনে পরিচালিত বাইওয়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের জন্য বিদেশি প্রশিক্ষক নিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেন সভাপতি আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, নীতি সহায়তাও দরকার। ব্রেড বিস্কুট, প্লাস্টিক ও ফার্মাসিউটিক্যালের যন্ত্রাংশ আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে তা আনতে চাইলে মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিলেই চলে। এটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈষম্য।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, হালকা প্রকৌশলশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানে সরকারের একটি বিশেষ সেল করা দরকার। সেখানকার প্রধান হিসেবে থাকবেন একজন সচিব। যিনি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবেন।