রসুইঘরের দেশীয় ব্র্যান্ড

দিল্লি অ্যালুমিনিয়ামের কারখানায় নানা রকম তৈজসপত্র তৈরির কর্মযজ্ঞ।  ছবি: সৌরভ দাশ
দিল্লি অ্যালুমিনিয়ামের কারখানায় নানা রকম তৈজসপত্র তৈরির কর্মযজ্ঞ। ছবি: সৌরভ দাশ

দুই থেকে আড়াই দশক আগেও রান্নাঘর, খাবার টেবিল বা প্রসাধনকক্ষে ছিল অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের প্রাধান্য। ধীরে ধীরে সিরামিক, কাচ, মেলামাইন, মরিচারোধী ইস্পাত বা প্লাস্টিকের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়ে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পণ্য। প্রতিযোগিতার কারণে খাবার টেবিল বা প্রসাধনকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেও রসুইঘরে এখনো কদর কমেনি অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের। রসুইঘরের এই ছোট্ট বাজারে সুপরিচিত ব্র্যান্ড হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে চট্টগ্রামের ‘দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম’।

প্রায় তিন দশক আগে চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় যখন এই কারখানার যাত্রা শুরু হয়, তখন অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের স্বর্ণযুগ শুরু। মাটির থালাবাসন বা কাঁসা–পিতলের হাঁড়ি–পাতিল হটিয়ে খাবার টেবিল, রসুইঘর বা প্রসাধনকক্ষে জায়গা নিতে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তৈজসপত্র। দেশের নানা এলাকায় তখন অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ছোট কারখানাও ছিল অসংখ্য। এমন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দিল্লি ব্র্যান্ডের জায়গা করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। 

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবু তাহের সওদাগর ১৯৭৮ সালে এই কারখানা স্থাপন করেন। উৎপাদন শুরু হয় প্রায় চার বছর পর। উৎপাদনের যন্ত্র ছিল চারটি। শুরু থেকেই আমদানি করা অ্যালুমিনিয়াম ইনগট দিয়ে কারখানায় তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। তাতে মরিচা পড়ত না। আবার টেকসইও হতো। মান ঠিক থাকায় ধীরে ধীরে গৃহিণীদের কাছে আস্থা অর্জন করতে থাকে। তাতে এই ব্র্যান্ডের পণ্যের প্রচারণায় কারখানার মালিকদের ভাবতে হয়নি। 

ব্যবসায়ী আবু তাহের সওদাগরের ছেলে মো. ইউসুফ কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আরেক ছেলে এশিয়ান অ্যান্ড ডাফ (দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি) গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শওকত এখন এই কারখানা পরিচালনা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই কারখানায় কখনো পুরোনো অ্যালুমিনিয়ামের টুকরো কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়নি। সব সময় অ্যালুমিনিয়াম ইনগট ব্যবহার হচ্ছে। পণ্যের উন্নত মান এবং টেকসই হওয়ায় কোনো প্রচারণা ছাড়াই দিল্লি ব্র্যান্ড ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে। অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের ব্যবহার কমলেও তাঁদের ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রিতে ভাটা পড়েনি বলে তিনি জানান। 

উদ্যোক্তারা জানান, এই কারখানার নাম ছড়িয়ে পড়ে ১৯৮৭ সালে অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডেকচি তৈরি শুরুর পর। তখন তামা, পিতলের বড় ডেকচির যুগ। পিতলের চেয়ে কম দামের অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডেকচি দ্রুত বাজার দখল করে নেয়। রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টার, ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য বড় ডেকচি বলতে ছিল দিল্লি ব্র্যান্ডের একচেটিয়া বাজার। অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডেকচির বিকল্প তৈরি হয়নি। ফলে তৈজসপত্রের বাজারে এটি অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের দখলে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বড় ডেকচি মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানিও হতো। 

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো ৪টি যন্ত্রের স্থলে এখন ৩০টির মতো যন্ত্র রয়েছে কারখানাটিতে। নতুন করে বসানো হয়েছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্টলে বিক্রির জন্য তৈজসপত্র উৎপাদন ও প্যাকেটজাত নিয়ে শ্রমিকদের ব্যস্ততা কারখানাজুড়ে। নানা আকার ও নকশার তৈজসপত্র উৎপাদনের পর কারখানার স্টোররুমে এনে রাখছেন শ্রমিকেরা। সেখানে সারি সারি করে কড়াই, ডেকচি, ললি সেট, মনি ডেকচি, ফ্রাইপ্যান, সসপেন, ভাপা পিঠা তৈরির পাতিল, গামলা, টিফিন ক্যারিয়ারসহ নানা ধরনের তৈজসপত্র প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। 

কারখানার কর্মীরা জানান, পুরো কক্ষজুড়ে থাকা এসব তৈজসপত্র শুধু বাণিজ্য মেলায় বিক্রির জন্য নেওয়া হবে। বাণিজ্য মেলা শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে কারখানায় দিন-রাত অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। এরপর চট্টগ্রামের বাণিজ্য মেলায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দরপত্রে অংশ নিয়েও তাঁরা পণ্য বিক্রি করেন। বাণিজ্য মেলায় স্টল দিয়ে দিল্লির পরিচিতি বেড়ে যায়। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার দ্বিতীয় আসর থেকে টানা ২৪ বার স্টল দিয়ে পণ্য বিক্রি করেছে দিল্লি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেন, বছরে একবার এই মেলা থেকে পণ্য কেনার জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকেন। 

চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় নিয়মিত অংশ নেওয়ার কারণে দিল্লি ব্র্যান্ড পরিচিতি পেয়েছে বেশি। অ্যালুমিনিয়াম খাতের তৈজসপত্রের বাজারে দেশীয় উদ্যোক্তারা ছোট-বড় কারখানা গড়ে তোলায় আমদানিমুখী হয়নি খাতটি। এতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি সামান্য পরিমাণে হলেও পণ্যটি রপ্তানিও হচ্ছে। 

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় দিল্লি অ্যালুমিনিয়ামের প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় দিল্লি অ্যালুমিনিয়ামের প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

তৈজসপত্রের বাজারে পরিবর্তন থেমে নেই। অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যেও এখন বৈচিত্র্য। অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন ও বিশেষ ধরনের লোহার উপাদান দিয়ে তৈরি কাঠামোয় পিটিএফইয়ের (পলি টেট্রা ফ্লুও রিথাইলিন) আস্তর দিয়ে তৈরি হচ্ছে ননস্টিক হাঁড়ি-পাতিল। এই পরিবর্তনে এবার সঙ্গী হয়েছে দিল্লি। ননস্টিক পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাজারে টপার, কিয়ামসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ননস্টিক পণ্যের সঙ্গে দিল্লি ব্র্যান্ডের পণ্যটিও এখন পাওয়া যাচ্ছে। 

 চট্টগ্রামের এশিয়ান অ্যান্ড ডাফ গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই কারখানা দিয়ে। দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি বা ডাফ নামটাও তাই গ্রুপের নামের সঙ্গে রেখে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। গ্রুপের প্রথম কারখানাটি খুব বেশি সম্প্রসারণ হয়নি। কারণ এই কারখানা থেকে যাত্রা শুরু করে গ্রুপটি নতুন নতুন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। গত চার দশকে গ্রুপটির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬–এ। এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যাই বেশি। তৈজসপত্রের কারখানা থেকে শিল্পগ্রুপে পরিণত হওয়া কোম্পানি একটিই বাংলাদেশে। 

এশিয়ান অ্যান্ড ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি এম এ ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম আমাদের পরিবারের প্রথম শিল্প। এরপরেই ধীরে ধীরে পোশাকসহ নানা খাতে ২৬টি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। নানা খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলেও পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে প্রথম কারখানাটি এখনো ধরে রেখেছি।’