কর্মসংস্থানে চার চ্যালেঞ্জ

সিপিডি আয়োজিত সংলাপে বক্তারা। গতকাল রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে।  ছবি: প্রথম আলো
সিপিডি আয়োজিত সংলাপে বক্তারা। গতকাল রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে। ছবি: প্রথম আলো

পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক যুব গোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে চারটি চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হলো জীবন ও জীবিকা; শিক্ষা; প্রশিক্ষণ এবং শোভন কাজের অভাব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর উদ্যোগ কম। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এশিয়া ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে। গবেষণার শিরোনাম ছিল প্রান্তিক যুবসমাজের কর্মসংস্থানে সরকারি পরিষেবার ভূমিকা। এ গবেষণার ওপর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেল এক সংলাপের আয়োজন করা হয়। 

সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। যাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। 

অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে জোর দিচ্ছে। কিন্তু এই অর্থনীতিতে বছরে কত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বলা উচিত, কোন বছর কত লোকের কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া আইন করে একটি যুব কর্মসংস্থান কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। 

রাজনৈতিক পরিচয়ই এখন সরকারি চাকরির মূল যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তাঁর মতে, ‘সরকার মনে করে, কে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে।’ 

সিপিডি গবেষণাটি পরিচালনার জন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়গত প্রান্তিক যুব জনগোষ্ঠী হিসেবে ঠাকুরগাঁওয়ের সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, দুর্যোগে আক্রান্ত শহুরে বস্তিবাসী; মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং ভৌগোলিক কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে সিলেটের শহরে যুব গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাদা কর্মশালার আয়োজন করে। এসব কর্মশালায় মোট ৩৩৩ জন অংশগ্রহণকারীর মতামত জরিপ করা হয়। 

গবেষণা ফল

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শতভাগ বস্তিবাসী যুব গোষ্ঠী, প্রায় শতভাগ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুবক শ্রেণি এবং ৮ শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর পরিবারের বসতভিটা নেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রায়ই উচ্ছেদের হুমকির মুখে থাকতে হয়। ৭ শতাংশ বস্তিবাসী ও তার পরিবার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। এর ফলে যুবকদের শৈশবজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটে। 

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সিলেটের শহুরে যুব গোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশই মনে করেন, তাঁদের স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের অর্ধেক। মতামত প্রদানকারীদের ৬০ শতাংশ মনে করেন, স্থানীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মান জাতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মানের অর্ধেক। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ পাওয়া গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ মিলে কম। স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৯৮ শতাংশ কারিগরি, মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর ২৮ শতাংশ ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ নেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রায়ই সরকারি প্রশিক্ষণ–সংক্রান্ত তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। 

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, সিলেটের ৭৩ শতাংশ যুবক এবং ঠাকুরগাঁওয়ের সমতলের জাতিগোষ্ঠীর ২৬ শতাংশ নিজের এলাকায় চাহিদামতো কাজের সুযোগ কম বলে মনে করেন। 

২০৩০ সালের মধ্যে দেশে নতুন ৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য রয়েছে। সিপিডির গবেষণায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারাবাহিকতায় কর্মসংস্থান হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা লক্ষ্যের অর্ধেক। 

আলোচনা 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাংসদ মুজিবুল হক নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘নিজের এলাকায় একটি কলেজ করেছি। এটা ভুল হয়েছে। আমার এলাকায় অনেক কলেজ আছে। কিন্তু একটি ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান করলে ভালো হতো। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে।’ তিনি বলেন, পোশাক খাতে স্যুট কাটিং মাস্টারের চাহিদা আছে, কিন্তু দক্ষ লোক না থাকায় শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে লোক আনতে হচ্ছে। 

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যুব জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করতে সরকার বিপুল টাকা খরচ করছে। কিন্তু সেই অর্থ খরচ কাজে আসছে কি না, তা দেখতে হবে। এখন যে মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে, চাকরির বাজারে তাঁদের নিতে অনীহা আছে। তাই চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি রয়ে গেছে। 

ঠাকুরগাঁওয়ের নৃগোষ্ঠীভুক্ত যুবক আন্দ্রে অগাস্তা বলেন, তাঁর এলাকার প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও চাকরিতে ভালো বেতন পাওয়া যায় না। 

রাজধানীর কড়াইল বস্তির তানজিনা আক্তার বলেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সবার আগে বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। 

বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, দেশে একটি কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিচয়ে সরকারি চাকরি হচ্ছে। 

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাংসদ নাহিম রাজ্জাক, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, ইউসেপ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক তাহসিনা আহমেদ, জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি সারাহ কামাল, বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর প্রমুখ।